বিবেকানন্দ চর্চা :- দ্বিতীয় পর্ব

By : Ashoke Mukhopadhyay | : 09 June, 2022
বিবেকানন্দ চর্চা :- দ্বিতীয় পর্ব

 

স্বামী বিবেকানন্দের রচনাবলিতে আমাদের প্রয়োজনীয় হিরের খনিগুলি নিয়ে কথা হচ্ছিল।

এবার আমি স্বামী বিবেকানন্দের স্বল্প পরিচিত কয়েকটা বইয়ের নাম উত্থাপন করব। “ভাববার কথা”, “প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য”, “বর্তমান ভারত” এবং “পরিব্রাজক”।

আগের পোস্টগুলোতে আমি যে বত্রিশটি উদ্ধৃতির কথা বলেছি, যেগুলি বিবেকানন্দ ভক্তরা তাঁর সমাজ সংস্কারের বাণী হিসাবে উদ্ধার করে থাকেন, এবং মার্ক্সবাদী ভক্তরা ধর্মীয় উদারতার সাক্ষ্য হিসাবে তুলে ধরেন, তার প্রায় সবই এই বইগুলিতে পাওয়া যাবে।

সেই উদ্ধৃতিগুলি কি ভুল? তার বক্তব্য কি গ্রহণ অযোগ্য?

না।

আমাদের আপত্তির জায়গা হল: স্বামীজি যদি শুধু এই বাক্যগুলো উচ্চারণ করে থেমে যেতেন, অসুবিধা ছিল না। কিন্তু তা নয়। এই বইগুলিতে তাঁর যা যা ভালো ভালো বয়ান আছে, তার প্রায় সব গুলিকেই তিনি অন্যত্র অন্য রকম কথা বলে নিজেই কাটান দিয়ে ফেলেছেন। সেখানেই তিনি স্ববিরোধী।

উনিশ শতকে বাংলা বা মহারাষ্ট্রে যে নবজাগরণ আসে, বিভিন্ন পথে তা ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে, পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে, দলিত ও নারীর অবমাননার বিরুদ্ধে নানা মাত্রায় সমাজ সংস্কারের আওয়াজ তোলে। সামাজিক জীবনে পুরনো ঐতিহ্য রক্ষা এবং ধর্মাচরণকে অস্বীকার অগ্রাহ্য বা নিদেন পক্ষে গুরুত্বহীন করতে চায়। তার পরিবর্তে আধুনিক শিক্ষার আহ্বান ও আবাহন জানায়। তার জমি-বাড়ি তৈরি করতে শুরু করে। বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদের সপক্ষে মত দেয় এবং রাস্তা বানাতে থাকে। নতুন সাহিত্য নবতর আঙ্গিকে মুদ্রণ ও মলাটের কায়ায় আত্মপ্রকাশ করে। দেবদেবীর গালগল্প পৌরাণিক উপাখ্যান পেছনে চলে যায়, সমকালিক মানুষই গল্প উপন্যাস নাটকে যাত্রাপালায় দেখা দিতে থাকে। বাংলায় বাংলা ভাষা আধুনিক গদ্যের বাহন হিসাবে কুচকাওয়াজ শুরু করে দেয়।

যিনি সমকালীন সমাজ জীবনে জাতীয় উন্নয়নের একজন প্রবল প্রবক্তা হিসাবে রেনেশাঁসের পক্ষ অবলম্বন করবেন, সবল ভাবেই হোক বা দুর্বল ভাবে, তাঁর কাছে আমাদের প্রত্যাশা কী হবে? তিনি কী করতে বলবেন? কিসে কিসে তিনি আপত্তি বা অসহমত জানাবেন?

এইগুলো হচ্ছে সেই যাচকাঠি, যা দিয়ে রেনেশাঁস কালের একজন গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের ঐতিহাসিক স্থান নির্ধারণ হয়।

ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রধান যে অবলম্বন জাতিভেদ প্রথা ও বর্ণবিদ্বেষ, তার বিরুদ্ধে অনেক ভালো ভালো গরম বাক্য উচ্চারণ করেও তিনি জানালেন, ব্রাহ্মণরা লেখাপড়া করেছে বলেই নাকি সমাজের মাথায় চেপে বসেছে, শূদ্ররা পড়ায় ফাঁকি দিয়েছে বলেই নাকি উচ্চবর্ণের সেবায় আত্মনিয়োগ করতে বাধ্য হচ্ছে। যারা পড়াশুনা করতে গেলে ক্ষত্রিয় রাজারা মুণ্ডচ্ছেদ করত, মুখে কানে গরম সিসে গলিয়ে ঢেলে দিত, জিভ কেটে ফেলত—করত যে তা কিন্তু স্বামীজি জানেন—তারা পড়ায় অবহেলা করল কখন? এই জায়গায় তিনি নগ্নভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদের পক্ষাবলম্বন করে রেনেশাঁসের গতিমুখের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গেলেন।

সতীদাহ প্রথা, বাল্য বিবাহ, বহুবিবাহের বিরুদ্ধে বিধবা বিবাহের সপক্ষে সমাজে যখন আলোড়ন শুরু হয়েছে, উচ্চবর্ণের ঘাড়ে মাথায় যখন কোপ পড়তে শুরু হয়েছে, সেই সময় হিন্দু সমাজের অনেক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এদিকে ওদিকে বেশ কিছু উষ্ণতাকর্ষী কথার বলার পরও এই সব তীক্ষ্ণ প্রশ্নে বিবেকানন্দ কোন পক্ষ নিলেন?

সতীদাহের পক্ষে। বাল্য বিবাহের পক্ষে। বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধে। অর্থাৎ, এক কথায় সিধে রেনেশাঁসের বিপক্ষে।

কী বলছেন দাদাভাই? প্রেক্ষিত বিচার করতে হবে? কোন প্রেক্ষিতে কোনটা বলেছেন ভেবে দেখা দরকার?

না। একদম না।

যদি ভালোমন্দ সত্যমিথ্যা বিচার করেন, তাহলে উপরের একটা প্রশ্নেও প্রেক্ষিত বিচারের কোনো প্রয়োজন নেই। সতীদাহ সর্বদাই খারাপ। বাল্য বিবাহ কখনই ভালো নয়। বিধবা বিবাহ প্রবর্তনই তখন সত্যের দাবি। প্রত্যেকটাই নারীর মর্যাদা ও সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত। কোনো প্রেক্ষিতেই এগুলোর পক্ষাবলম্বন সিদ্ধ নয়।

আর যদি সময়ের দাবির নিরিখে বিচার করেন, তাহলে সেদিনকার আলোচ্য প্রেক্ষিতই বলে দেবে, স্বামীজি তাঁর এই সব সংশ্লিষ্ট বয়ানে প্রতিটি ক্ষেত্রেই সনাতন ধর্ম ও ঐতিহ্য রক্ষার স্বার্থে সমাজের অগ্রগতির বিরুদ্ধে বলেছেন। নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও সমান অধিকারের বিরুদ্ধে বলেছেন। তাঁর স্বভাব সিদ্ধ জোর গলায়। অসম্ভব বাগ্মীতা সহযোগে।

আদর্শগত দিক থেকে অবস্থান তাঁর তখন রাধাকান্ত দেবের মতো। কিংবা বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে তুলনীয়। আগাপাঁশতলা প্রতিক্রিয়াশীল। কিন্তু বয়ান অনেক বেশি ভাবগম্ভীর, আবেগ সিঞ্চিত, সেই জন্যই বেশি ক্ষতিকারক। বেশি কুফলবতী। রাধাকান্ত দেব সমাজ সংস্কারে বাধা দেবার জন্য কুসংস্কারগ্রস্ত রক্ষণশীলদের সমবেত করে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করেন। বঙ্কিম প্রাচীন কুপ্রথার সপক্ষে পণ্ডিতি ওকালতি জজিয়তি যুক্তি সাজান। একথা ঠিক, স্বামীজি তদ্দুর যাননি, দুটোর কোনোটাই করেননি। কিন্তু তিনি যা করেছেন তা আরও লক্ষ্যভেদী, আরও গভীরগামী। তিনি তাঁর আবেগময় বচনে বাচনেই অনেক বেশি বাজিমাত করে ফেলেন।

পৈশাচিক নরহত্যা হিসাবে গণ্য হওয়ায় ইংরেজ ব্যাটনের ভয়ে আইনের জোরে সতীদাহ বন্ধ হয় ঠিকই, কিন্তু পিশাচ মনগুলি রাধাকান্ত-বঙ্কিমের শুষ্ক কচকচির মধ্যেই নয়, স্বামী বিবেকানন্দের ললিত বাণীতেও, অনেক বেশি সাহস পায়, ভরসা পায়। পতিব্রতা স্ত্রী “স্বেচ্ছায়” সহমরণে যাইতে ভয় পাইবে নাক’। মরিবেই মরিবে। আমরাও সুখে মারিতে পারিবই পারিব। “জহরব্রত” নামক গল্পগাথাকে তিনি সজীব করে তোলেন। তাই বিবেকানন্দ ব্যানারে সুসজ্জিত হয়ে বিজেপি-র মতো শক্তি সংসদীয় রাজনীতিতে শক্তিশালী হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই যে রাজস্থানে সতীকাণ্ড ঘটে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

বিবেকানন্দ যখন বলেন, কোনো সমাজের উন্নতি তাহার নারীদিগের পতির সংখ্যার দ্বারা সূচিত হয় না, তখন বিধবা বিবাহের সংস্কারের বিরুদ্ধে সেই কুযুক্তির শক্তি হয় প্রবলতর। তাঁর প্র্যাকটিক্যাল বেদান্তের খিচুরি সহযোগে নানা ভাবে বলা সেই সব কথার অপপ্রভাব—বিদ্যাসাগরের উদ্দেশে কোথায় কোন কোণায় খামচিতে তিনি একবার {হ্যাঁ, মাত্র একবারই} প্রণাম করেছেন তা দিয়ে—খর্বীভূত হয় না। তিনি যদি নীরব থাকতেন তাহলেও হয়ত ক্ষতি কম হত। আর তিনি যদি বলতে পারতেন, আমাদিগের অপেক্ষা অন্যতর পথে বিদ্যাসাগর মহাশয় যাহা করিয়াছেন তাহাতেও ভারতীয় হিন্দু সমাজের মঙ্গল হইবে—তাহলে তো খুবই চমৎকার হত।

তিনি ঠিক এর উলটো কাজটি করে গেছেন। সেই বিপ্রতীপ বক্তব্যের প্রভাব আজও এত ব্যাপক যে ভারতীয় বা বাংলার জন সমাজে আজও বিদ্যাসাগরের আবেদন তেমন করে গৃহীত হয়নি, যতটা বিবেকানন্দের বাণী আসর জাঁকিয়ে বসে আছে।

এই জন্যই আমরা তাঁর সমাজ সংস্কার বিরোধী ভূমিকাকে দুর্বলতা বা আপস নয়, রেনেশাঁস বিরোধী অবস্থান হিসাবে মনে করি। সেদিনের সমাজ বিকাশের প্রগতি অভিমুখের সচেতন ভাবে উত্তোলিত দেওয়াল বলে চিহ্নিত করতে বাধ্য হই।

রামমোহনের সঙ্গে বিবেকানন্দের তুলনা করলে আমরা দেখব: দুজনেই বেদান্তবাদী, ধর্মীয় বৃত্তের মধ্যে অবস্থানকারী। আপাত দৃষ্টিতে দুজনের অবস্থান এক রকম বলে বিভ্রান্তি জন্মাতেই পারে। কিন্তু আরও গভীরে দৃকপাত করলে দেখতে পাব—রামমোহনে রয়েছে ধর্ম থেকে বেদান্ত নামক সিজাভাত থেকে বেরিয়ে আসার প্রবণতা, কেন্দ্র থেকে ধীরেসুস্থে পরিধি পর্যন্ত এসে হয়ত থেমে আছে; অচিরে বিদ্যাসাগর দত্ত মিত্ররা সেই পরিধির বাইরে চলে আসবেন; আর স্বামীজি শুধু যে পরিধি থেকে উলটো পথে হেঁটে সেই বৃত্তের ভেতরে কেন্দ্রের দিকে সেঁধিয়ে যাচ্ছেন তাই নয়, দলে দলে লোককে প্রভাবিত করে সেদিকেই টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। [ছবিটা দেখুন]

বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠের ভক্ত ছাত্রদের পক্ষে এতটা বোঝা বা গ্রহণ করা কঠিন। মস্তিষ্কের বোধিশ্লেটে প্রচুর ধোওয়ামোছা ঘসামাজা করতে হতে পারে। কিন্তু মার্ক্সবাদী ভক্তরা অন্তত যদি স্রোতভাসানি সাঁতার ছেড়ে উঠে এসে বিষয়টা বুঝে নিতে পারেন, তাহলে দেশের ও দশের মঙ্গল।                                                                                                                                                                                                                                                                                                    

বিবেকানন্দের জীবন কালের আগে পরে ভারতের সেই সময় (ধরা যাক, ১৮৪০-১৯২০) ঠিক কোন ধরনের দর্শনচিন্তার প্রয়োজন ছিল? কে বা কারা সেই দার্শনিক চাহিদা মেটাতে আগ্রহী ও উদ্যোগী হয়েছিলেন? কে বা কারা সেই আগ্রহে ও উদ্যোগে ঠান্ডা পানি ঢেলে দিয়েছিলেন?

এবারে সেই প্রশ্ন।

একটা পর্বে (ধরা যাক ১৮৪০-৯০) বঙ্গীয় রেনেশাঁস তার নানা শক্তি ও দুর্বলতার লাঞ্ছন বহন করে ধাপে ধাপে এগোচ্ছে, অক্ষয় দত্ত বিদ্যাসাগর রাজেন্দ্রলাল মিত্র মাইকেল মধুসূদন হয়ে জগদীশ্চন্দ্র বসু রবীন্দ্রনাথ দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রফুল্লচন্দ্র রায় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রোকেয়া শাখাওয়াতের জন্ম দিচ্ছে। নাটকে যাত্রাপালায় উপন্যাসে নতুন ভাবনা জারিত হতে শুরু করেছে। বাংলায় অসংখ্য দৈনিক সাপ্তাহিক পাক্ষিক ও মাসিক সংবাদপত্র এবং সাহিত্য পত্রিকার উদয় হচ্ছে। দুটো জায়গায়—বাংলা সাময়িক পত্রে এবং জাতীয় নাট্যমঞ্চে জাতীয়তাবাদী চিন্তাচেতনা যুক্তিবাদ ও নৈতিক মূল্যবোধের উদ্গম দেখা যাচ্ছে। তখন সেই নবজাগৃতির আন্দোলনের সামনে চাই বাস্তবসম্মত চিন্তাচেতনা। আত্মা পরমাত্মার সন্ধি সমাস নয়। কৈলাস বা তপোবনের ব্রহ্মতালাশি ধ্যানমগ্নতা নয়। ইংরেজি ভাষা, বিশ্ব ইতিহাস (যদ্দুর পাওয়া যায়), আধুনিক গণিত, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র, জীববিজ্ঞান, ভূবিদ্যা, ইত্যাদি অধ্যয়ন করতে হবে। ইউরোপের রেনেশাঁস উত্তরকালের মানবতাবাদী সাহিত্যের সন্ধান পেতে হবে। ইউরোপ যেমন করে জ্ঞান বিজ্ঞান শিল্পসাহিত্যের ক্ষেত্রগুলিকে ধর্মতন্ত্রের অক্টোপাসি গ্রাস থেকে একটু একটু করে মুক্ত করে এগিয়েছে, এখানেও তেমন করেই সনাতন ধর্মের ব্রাহ্মণ্যবাদের বেড়াজাল কেটেই সামনের দিকে তাকাতে এবং এগোতে হবে। মুসলিম সমাজকেও ইসলামের সর্বঘের ফাঁসকল থেকে বের করে আনতে বা বেরিয়ে আসতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

সেই সময় তদীয় গুরুদেব কী দিলেন? কালীভক্তি। কালী মূর্তির দিন ভর পান ভোজনে আত্মনিবেদন বা তার এক অনারোগ্য হ্যালুসিনেসন। সঙ্গে রাণিমায়ের দয়ায় বছরে মাঝে মধ্যে কাঙালিভোজন। শীতবস্ত্র ও কম্বল দান। শিব জ্ঞানে জীব সেবা! উঁহু, না না। জীব জ্ঞানে শিব সেবা। অজ্ঞানেই কর্ম ভাব আসে। ব্রহ্ম জ্ঞান হলে আর কর্মে প্রবৃত্তি থাকে না। তখন আসে নিখাদ ভক্তি। কর্মের অহং চলে যায়! তুমি কে হে বাপু জগতের হিত করবে? তিনি না চাইলে গাছের পাতাও নড়ে না!

তাঁর শিষ্য আবার এত কমে সন্তুষ্ট নন। তিনি মুমূর্ষু হিন্দু ধর্মকে আবার বড় স্কেলে বাঁচিয়ে তুলতে চান। তার জন্য কর্ম করতেই হবে। তবে সে কি গীতা উবাচ নিষ্কাম কর্ম হবে? আরে ছ্যা ছ্যা, ফল চাই বাবা, হাতে হাতে ফল দেখাতে হবে। বিদেশে গিয়ে দুচার পিস অন্তত সাদা চামড়াওয়ালা ক্যাডার রিক্রুট করতে হবে। নইলে আম জনতা তো দূরের কথা, গুরুভাইরাও মানবে না।

অতএব বিবেকানন্দ দক্ষিণেশ্বরের গণ্ডী ছাড়িয়ে দেশের সামনে এক নতুন চিন্তা নিয়ে উপস্থিত হলেন। তাকে নাম দিলেন তাঁর নতুন “সমর নীতি”।

সে হচ্ছে রামানুজ আর শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত বেদান্তের পঞ্চাশ-পঞ্চাশ মিশ্রণে এক ব্যবহারিক প্রয়োগনীতি। প্র্যাকটিক্যাল বেদান্ত। তিনি বুঝেছেন, দিন কাল যা পড়েছে, তাতে কর্মকে শিকেয় তুলে দিয়ে মঠে মন্দিরের ভেতরে ভক্তি ভজনে দিন কাটালে চলবে না। ধর্ম প্রচার করতে হলে কর্ম করতে হবে সাড়ম্বরে। লোকজন জুটলে তখন আবার কিঞ্চিত ব্রহ্ম চর্চা!

কী জিনিস সেটা?

ক্লাসে ভাষণে দার্শনিক সভায় ধ্যানে মন্দিরের চাতালে জীবাত্মা ও পরমাত্মার অভেদ জ্ঞান সাধনা। আমিই সে (সোহহং), তুমিই সে (তত্ত্বমসি), এই আত্মাই ব্রহ্ম (অয়মাত্মা ব্রহ্মঃ), আমিই ব্রহ্ম (অহম ব্রহ্মাস্মি), সর্বং খল্বিদং ব্রহ্মঃ, ইত্যাদি। নিগূঢ় তত্ত্ব জ্ঞান। ব্রহ্ম আমাতে আমি ব্রহ্মে লীন। তবে, চিরস্থায়ীভাবে লীন হলে চলবে না। শঙ্কর যেমন বলেছেন, ঘুমের ঘোরে।

শূদ্রদের অবশ্য এতটা ব্রহ্মের ধারে কাছে যেতে দেওয়া যাবে না। এই ব্রহ্ম সমীকরণগুলি শূদ্রদের আশেপাশে গেলেই অসিদ্ধ হয়ে যাবে। ওরা অনেক দিন পড়াশুনা করেনি। এখন একটু লঙ্গরখানায় খেয়ে দেয়ে লেখাপড়া শেখার কথা ভাবুক। ওদের জন্য শাস্ত্রোক্ত কর্ম করুক, অন্য উচ্চবর্ণের সদস্যদের সেবাটেবা করুক। হাজার হোক, ওরাও তো অবোলা অবল জীব। জীব সেবা --- জীবে প্রেম করে যেই জন সেই --- ।

রচয়িতা যিনিই হন, গীতায় অসীম সময়ের ওয়ারান্টি দিয়ে বলা আছে, কৃষ্ণপাদের টোল ফ্রি নম্বরে শরণ নিলে কুকুর শূদ্র এবং নারী সকলেই মোক্ষলাভ করতে পারবে। আধ্যাত্মিক পরিসরে ব্রহ্মের বাইপাস সার্জারি আর কি!

আর ক্লাসের বাইরে? উপাসনা কক্ষ থেকে বেরিয়ে?

ঘেঁটু পুজো, শীতলা পুজো, কুমারী পূজা, শিব কালী কৃষ্ণ হনুমান আরাধনা, দুর্গাপূজায় নবমীতে পাঁঠাবলি, রাস্তায় গড়াগড়ি, সকলই তোমারই ইচ্ছা, ইচ্ছাময়ী তারা তুমি। তোমার কম্ম তুমি কর মা, লোকে ভাবে করি আমি।

আম পাব্লিক অত আত্মাফাত্মা বুঝবে না। অদ্বৈতটদ্বৈত ওদের মাথায় ঢুকবে না।

ঢোকানোর দরকারও নেই। গুরুদেব বলেই গেছেন, যত মত তত পথ। শাক্ত মত ও পথ, বৈষ্ণব মত ও পথ, শিবের মত ও পথ, রামের মত ও পথ, ঘেঁটুর মত ও পথ।

সত্যিই সে এক বিচিত্র প্র্যাকটিক্যাল বেদান্ত। যেখানে বেদান্ত চর্চা, সেখানে প্র্যাকটিক্যালি কোনো কাজ কর্ম নেই। থাকার কথাও নয়। বেদান্ত মানেই জ্ঞান কাণ্ড, কর্ম কাণ্ড নয়। সেখানে শুধুই বচন কৃষি। ব্রহ্মকে যে মুখে বলে বোঝানো যায় না, সে যে এঁটো হয়নি (রামকৃষ্ণ)—সাহিত্যিক শরৎচন্দ্রের কথা মতো—বারবার মুখে বলেই, এঁটো করেই, সেটা বোঝাতে হবে। অনির্বচনীয়ভাবে বচনান্তিক!

আর যখন বিবেকানন্দের নির্দেশ মতো আপনি প্র্যাকটিক্যাল কাজে নেমে পড়লেন, প্লেগাক্রান্তদের সেবায় আত্মনিয়োগ করলেন, সেখানে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বেদান্তকে বিদায় জানিয়ে দেওয়া হল। মায়া প্রপঞ্চে জড়িয়ে পড়লেন আপনি। আদি মান্য ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রমতে বেদান্তে যা যা নিষিদ্ধ, ঠিক সেইগুলিই তখন আপনি করছেন। কিন্তু লঙ্ঘন করেও তাকেই বেদান্ত অনুসরণ বলে চালাতে বাধ্য হচ্ছেন। স্ববিরোধিতা নামক শাস্ত্র আপনাকে বাধ্য, থুরি, অনুপ্রাণিত করছে।

এই প্র্যাকটিক্যালে মুসলমানদেরও নিতে হবে বইকি! ওরা খুব খাটতে পারে। পরিশ্রমের শরীর ওদের। তাই আগামী দিনে ভারতে ইসলামের শরীরকে সঙ্গে নিতে হবে। মাথা, মগজ কিন্তু ওদের এক্তিয়ারে দেওয়া যাবে না। ওটা থাকবে হিন্দুদের দখলে। বৈদান্তিক। ভারি জ্ঞানের, থুরি, শাস্ত্রসিদ্ধ অ-কাজের জিনিস!

এই হচ্ছে স্ট্র্যাটেজি। এর মধ্যে কোথাও সমকালীন সমাজের ও সময়ের একটাও সমস্যার দিকে সামান্যতম দৃষ্টিপাত নেই।

আসল কথা হচ্ছে, ধর্মীয় দর্শন মানলে থাকার কথাই নয়।

এই জন্যই সমকালীন সমস্যার সমাধানের দিকে মাথা দিতে গিয়ে ঈশ্বরচন্দ্র সাংখ্য থেকে শুরু করে বেদান্ত পর্যন্ত সমস্ত প্রাচীন হিন্দু দর্শনকেই শিক্ষার ফাইলে নোট লিখে দাগিয়ে রাখলেন “ভ্রান্ত” বলে। এক ব্র্যাকেটে। অক্ষয়কুমার দত্ত আবার এক কাঠি উপর দিয়ে যান। তিনি ষড়দর্শনের আলোচনার সূত্রপাতেই তাকে সামগ্রিকভাবে চিহ্নিত করলেন “ভ্রান্তিভূধর” হিসাবে। কিছু কিছু ভালো কথা বা সত্য কথা থাকলেও এই সব দর্শন দিয়ে উনিশ বা বিশ শতকের যুগযন্ত্রণার সমাধানের পথের হদিশ পাওয়া সম্ভব নয়।

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় আরও স্পষ্টবক্তা। বিদ্যাসাগর-দত্ত স্কুলেরই লোক তিনি। প্রাচীন ও মধ্য যুগের ভারতের বিজ্ঞানের ইতিহাস চর্চা করতে গিয়ে তিনি দেখলেন, এবং বলেও ফেললেন, শাঙ্কর দর্শন এবং শাস্ত্র সিদ্ধ জাতপাত ব্যবস্থার কঠোরতার কারণেই প্রাচীন কালে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়ে শুরু হলেও ভারতে বিজ্ঞানের চর্চা এক সময় থেমে গেছে। অর্থাৎ, আবার এখন যদি বিজ্ঞানের বিকাশ ঘটাতে হয়, প্রথমেই চিন্তার জগত থেকে, মাথা থেকে বিবেকানন্দ কথিত “সর্বোচ্চ জ্ঞানের আকর” স্বরূপ এই বেদান্তকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। তিন দশক পরে আচার্য মেঘনাদ সাহা এবং ছয় দশক পরে আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুও প্রায় একই কথা বললেন। অর্থাৎ, প্র্যাকটিক্যাল ক্ষেত্রে বেদ-বেদান্তকে বিয়োগ না করলে নানা রকম বিয়োগান্ত নাটক বসে বসে দেখতে হবে।

সুতরাং নবজাগৃতি কালের কর্ম ও জ্ঞানের বিকাশে স্বামীজির অবদান—হিন্দি ভাষায় যাকে বলে—নকারাৎমক!

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

লেখক পরিচিতি

Ashoke Mukhopadhyay
Ashoke Mukhopadhyay
Free-lance science writer and activist; General Secretary of CESTUSS and The Other Mind.
9 Comments
  • avatar
    iHerb Code

    19 October, 2022

    Your phrase simply excellent

  • avatar
    RustyPen

    08 November, 2022

    iHerb discount code | 35% Off November >> https://code-herb.com/

  • avatar
  • avatar
    Ernestdon

    27 December, 2022

    online casino site

  • avatar
  • avatar
    ThomasTrome

    25 January, 2023

    https://heating-film.com/

  • avatar
    JimmyDok

    03 February, 2023

    https://cwcab.com/?URL=tecenet.com/extend/redirect.php?url=hot-film.com.ua http://cse.google.co.ug/url?sa=t&url=http%3A%2F%2Fheating-film.com%2F http://devereuxfamily.co.uk/__media__/js/netsoltrademark.php?d=heating-film.com https://cse.google.nu/url?q=http://teplapidloga.com.ua/ http://normschneeberger.net/__media__/js/netsoltrademark.php?d=heating-film.com

  • avatar
    Harolderedy

    26 April, 2023

    Помощь

  • avatar
    JeffreyMaymn

    12 January, 2024

    https://dubaipeople.ae/blog/how-to-book-an-excursion-fishing-in-dubai/

Leave a reply

Reclaiming the Dark

28 August, 2024 | : Ashoke Mukhopadhyay

Science vs Spiritualism

24 July, 2024 | : Ashoke Mukhopadhyay

Religious Fundamentalism

09 June, 2022 | : Ashoke Mukhopadhyay