দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ

By : Ashoke Mukhopadhyay | : 11 January, 2025
দ্বন্দ্বমূলক  ও ঐতিহাসিক  বস্তুবাদ

http://dialectical materialism.pathachakra(মুখবন্ধ :- দেশ তথা বিশ্বে অহরহ ঘটে চলা বিভিন্ন ঘটনার সামাজিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব অনুধাবন ও সঠিক বিশ্লেষণের জন্য নিজেদের চিন্তা-ভাবনার স্তরকে উন্নততর করতে হবে,এবং মার্ক্সবাদ তথা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা-বিতর্কের  মাধ্যমেই তা সম্ভব,এই তাগিদ থেকেই সমমনস্ক কয়েকজন মিলে বছর দেড়েক আগে  "মার্ক্সীয় পাঠচক্র" গড়ে তোলেন। অতঃপর শুরু হয় এক ঘরোয়া আলোচনাচক্র। গ্রুপের তরফে সর্বসম্মতভাবে সেস্টাস মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক অশোক মুখোপাধ্যায়কে এই ধারাবাহিক আলোচনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। বিভিন্ন পর্বে আলোচিত বিষয়বস্তু ও প্রশ্নোত্তর পর্বের অডিও রেকর্ডিং থেকে বিস্তর ধৈর্য্য, পরিশ্রমের দ্বারা বক্তব্যের পরিমার্জিত লিখিত রূপ দিয়েছেন গ্রুপেরই কয়েকজন সদস্য।তার ফলশ্রুতি এই ধারাবাহিক রচনাপর্ব।

যুক্তিবাদী,বিজ্ঞানভিত্তিক মন-মানসিকতা গড়ে তুলতে কিছুটা হলেও সাহায্য করবে,এই ভাবনা থেকেই সেস্টাস মঞ্চের ওয়েবসাইটে এটি প্রকাশ করা হল।)

                            দ্বন্দ্বমূলক    ঐতিহাসিক  বস্তুবাদ 

                                   অশোক মুখোপাধ্যায়

                                             


 

                                             প্রথম খণ্ড: বস্তুবাদ দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি

ভূমিকা

আমরা সংখ্যাল্প কয়েকজন ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সমমনস্ক বন্ধু মিলে আকস্মিক ভাবেই ঠিক করেছিলাম,মার্ক্সবাদ সম্পর্কে, বিশেষ করে দ্বান্দ্বিক তত্ত্ব এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সম্পর্কে,আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিগত অবস্থান কেমন হওয়া উচিত তার উপর একটা সামগ্রিক বিস্তারিত আলোচনা সংগঠিত করা হবেঘটনার জটিল আবর্তে এই আলোচনার দায়িত্ব প্রাথমিক ভাবে আমার উপর এসে বর্তেছেপ্রতি মাসে একবার বা দুবার ঘরোয়া ভাবে কোথাও মিলিত হয়ে এই আলোচনা আমরা চালিয়ে নিয়ে যাবআলোচনার পরে প্রশ্নোত্তর পর্বও থাকবেসেই সব আলোচনাকে রেকর্ড করার ব্যবস্থা করা হয় এবং কয়েকজন মিলে অপরিসীম পরিশ্রম করে সেই রেকর্ড থেকে কথাগুলো টাইপ করে ফেলেছেনএর ফলে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো একটা দলিল তৈরি করা সম্ভব হবে এবং তাকে বই আকারে ছাপানোও যেতে পারেতবে আমরা স্থির করেছি,মার্ক্সীয় পাঠচক্র আয়োজিত এই ক্রমিক আলোচনায় মরিস কর্নফোর্থের Dialectical Materialism: An introduction বইটিকে প্রধানত সামনে রেখে আমাদের নিজস্ব বিচার বিবেচনাকে পাথেয় করে এগোব

কেন, সে ব্যাপারে শুরুতে কিছু কথা বলে নিতে চাই

মার্ক্সবাদের উপরে ছোট বড় মিলিয়ে অনেক বই লেখা হয়েছে বিভিন্ন দেশে কালেপ্রায় সমস্ত বইয়েরই বক্তব্য কম বেশি সঠিক এবং উপস্থাপনা প্রাঞ্জলএমিল বার্ন্‌স,ওভসি ইয়াখোৎ,জন লিউইস,হাওয়ার্ড সেলসাম,ডেভিড গেস্ট,সরোজ আচার্য,রাহুল সাংকৃত্যায়ন, প্রমুখ বিশিষ্ট লেখকদের রচিত এই জাতীয় বইগুলির সঙ্গে মার্ক্সবাদী কর্মী মহলের সকলেরই পরিচয় আছেএই সমস্ত বইয়ের ভেতর থেকে আমরা বেছে নিয়েছি প্রথমত দুটি বইএকটা হল মরিস কর্নফোর্থের উপরোক্ত বইআর একটা হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে প্রকাশিত The Fundamentals of Marxist-Leninist Philosophy (১৯৭৪)দুটি বইতেই মার্ক্সবাদী দর্শনের একটা সামগ্রিক পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে যথাসম্ভব সহজ সরল ভাষায়

তার মধ্যে আবার কর্নফোর্থের বইটার কিছু অতিরিক্ত ভালো দিক আছে

এক নম্বর, তিনি মার্ক্সবাদের আলোচনাকে তিন ভাগে ভাগ করে নিয়েছেন, ক) বস্তুবাদ দ্বন্দ্বতত্ত্ব, খ) ঐতিহাসিক বস্তুবাদ, এবং গ) জ্ঞানতত্ত্বআমার জানায় মার্ক্সবাদী সাহিত্যে এটাই সম্ভবত একমাত্র বই যেখানে মার্ক্সীয় জ্ঞানতত্ত্বকে আলাদাভাবে এতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছেসোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ১৯৪০-এর দশকে যে বইটা বেরোয়, বা,উপরে আমরা যে বইয়ের কথা উল্লেখ করেছি (আসলে পুরনো বইটিরই একাধিক সংশোধিত পরিমার্জিত সংস্করণ),তার কোনোটাতেই মার্ক্সীয় জ্ঞানতত্ত্বকে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপন করা হয়নি, যদিও জ্ঞানতত্ত্বের বিভিন্ন সমস্যাকে ধরে সেখানে আলোচনা করা হয়েছেএবং সেই আলোচনা যথেষ্ট মূল্যবান

দ্বিতীয়ত, তিনটি ভাগেই কর্নফোর্থ অধ্যায়গুলিকে খুব সুন্দর পর্যায়ক্রমে বিন্যস্ত করে সাজিয়েছেনএকটা বিষয় থেকে অন্য বিষয়ে যাওয়ার পর্বান্তরকে যে অধ্যায়গুলিতে ভাগ করে দিয়েছেন, তাতে সাধারণ পাঠকদের পক্ষে সমস্যাগুলিকে ধরতে সুবিধা হয় বলে আমাদের ধারণামার্ক্সবাদ সম্পর্কে একটা বুনিয়াদি ধারণা লাভের জন্য বিষয়বস্তুর এই ধারাবাহিক বিন্যাস খুবই জরুরিঅন্তত আজকের দিনে

তৃতীয়ত,সমগ্র বইটি জুড়েই লেখক মার্ক্সবাদের প্রধান পাঁচ জন মহারথীকে সামনে রেখে তাঁদের অসংখ্য প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি সন্নিবেশিত করেছেনফলে এক দিকে বিভিন্ন তাত্ত্বিক সমস্যাগুলির উপর কার্ল মার্ক্স, ফ্রেডরিক এঙ্গেল্‌স, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন, যোশেফ স্তালিন এবং মাও সে-তুং কোথায় কী বলে গেছেন, তা সরাসরি জানতে সুবিধা হয় এবং সেই সব উৎস গ্রন্থগুলিকেও পাঠ করার আগ্রহ জন্ম নেয়আর যেহেতু প্রতিটি অধ্যায়ের শেষেই সংশ্লিষ্ট সূত্রোল্লেখ রয়েছে, ফলে সেই সেই বইগুলি খুঁজে নিয়ে ইচ্ছে হলে আরও বেশি করে পড়ে এবং জেনে নেওয়া যায়

তবে এও বলে রাখা দরকার যে এই বইতে যে সাধারণ উপস্থাপনা রয়েছে, সেটা মোটামুটি ১৯৫০ সাল পর্যন্ত বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন সমাজতান্ত্রিক শিবিরের মূল ধারার রাজনীতির সঙ্গে খাপ খেয়ে গেলেও, সমাজতান্ত্রিক শিবিরের উত্থান পতন এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনের নানা রকম দুর্যোগের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমরা এখন বিভিন্ন সমস্যাকে যেভাবে বুঝি বা দেখতে অভ্যস্ত, তাতে বইটিতে কোথাও কোথাও নানা প্রসঙ্গে কিছু কিছু ভুল ত্রুটি সীমাবদ্ধতা অসম্পূর্ণতা চোখে পড়েসেরকম অধিকাংশ প্রসঙ্গ আমরা সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ের আলোচনা করার সময় উল্লেখ করবকিন্তু দু-চারটে কথা শুরুতেই বলে নেওয়া দরকার।     

যেমন, প্রথমেই এই বইটার প্রথম সংস্করণের প্রথম অধ্যায়ের নাম এবং প্রথম বাক্যটির দিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইঅধ্যায়টির শিরোনাম হচ্ছে Party Philosophy এবং আলোচনা শুরু হচ্ছে এই ভাবে: “Dialectical Materialism has been defined by Stalin as the world outlook of the Marxist-Leninist Party.” [Cornforth 1979, 1; Stalin 1949, 3] টেকনিক্যাল অর্থে এই কথাটা ভুল নয়এটা সত্যি যে একটা কমিউনিস্ট পার্টি যে দর্শনকে অবলম্বন করে চলে তা হচ্ছে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদকিন্তু আমরা ব্যাকরণে যে সাবজেক্ট এবং প্রেডিকেট বলি, কোনটা সাবজেক্ট এবং কোনটা প্রেডিকেট তার উপর বাক্যের অন্তর্নিহিত অর্থ অনেকটাই বদলে যায়আমরা যখন “Marxism-Leninism” কে সাবজেক্ট হিসেবে দেখি, তখন সেখানে প্রেডিকেট হচ্ছে “philosophy of the working class party” বা “philosophy of the communist party”আবার যদি উল্টে বলি, তাহলে হবে: “The communist party has its philosophy in Marxism-Leninism”, বা, “dialectical materialism”এখন এই বাক্যটি টেকনিক্যালি আরও সঠিকওই যে প্রথম বাক্যটি, সেটার সমস্যা হল এই দর্শনের কার্যকর এলাকাকে খানিকটা সঙ্কুচিত করে দেওয়া

কীভাবে, বিষয়টা একটু খুটিয়ে বুঝে নেওয়া যাক

অনেকেই সম্ভবত জানেন, এখনকার পোস্টমডার্নিস্টরা যেটা করেন, তাঁরা বলেন যে আধুনিক বিজ্ঞান হচ্ছে বুর্জোয়াদের বিজ্ঞান, কর্পোরেটদের বিজ্ঞানকথাটা কিন্তু পুরোপুরি ভুল নয়বিজ্ঞানের যা উন্নয়ন, তার যা ফান্ডিং, টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স, ফাইন্যান্স বা অ্যাপ্লিকেশন, শিল্পোন্নত দেশগুলিতে তার সবই প্রায় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলি করছেআর সেখানেই অধিকাংশ বড় বড় আবিষ্কার উদ্ভাবনগুলি হচ্ছেফলে এই কথাটা এইটুকু বললে টেকনিক্যালি কোনো ভুল হবে নাসমস্যাটা হচ্ছে, বিজ্ঞান বললে আমরা যা বুঝি, যাকে পাই, তা কি শুধুমাত্র বুর্জোয়াদের বিজ্ঞান? বা বিজ্ঞান মানে কি শুধু কর্পোরেটদের ব্যাপার? তাও নয়বিজ্ঞান অন্য অনেক দিক থেকে আমাদের সাহায্য করছেবিজ্ঞানে যারা আসছে, তারা সবাই কর্পোরেটদের জন্য কাজ করছে তাও নয়কর্পোরেট সংস্থাগুলি বিজ্ঞানকে যতটা সম্ভব শেকলে বেঁধে রাখতে চাইছেতা সত্ত্বেও বিজ্ঞানের একটি সর্বমানবিক দিক আছেএই বিষয়গুলো ওই বিবৃতির মধ্যে একেবারে আড়ালে পড়ে যায়যেমন ধরা যাক, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান মানেই কি শুধু একটি কর্পোরেট হাতিয়ার? এই যে কথাটা আমরা এদিক ওদিক শুনি, এটাও কি পুরোটা সত্য? না, এটা একটা অর্ধ সত্যবাস্তবের এক পিঠ

কিছু দিন আগে মারা গেছেন ড. স্থবির দাশগুপ্ততিনি খুবই ভালো মানুষ ছিলেন এবং এই বাজারে কর্পোরেট চিকিৎসার বিরুদ্ধে সারা জীবন একাই প্রায় লড়াই করে গেছেনতাঁর এই জীবনভর সংগ্রামকে আমরা শ্রদ্ধা করিকিন্তু সমস্যা হচ্ছে, বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁর তত্ত্ব ছিল এই রকম: গোটা চিকিৎসা বিজ্ঞানটাই হচ্ছে একটি কর্পোরেট সায়েন্স; কর্পোরেট সায়েন্স আমাদের এই দিকে নিয়ে যাচ্ছেআমাদের অসুখ হলে কর্পোরেটরা চিকিৎসার ধারা ঠিক করে দিচ্ছেএইভাবে তিনি আধুনিক মেডিকেল সায়েন্স প্রয়োগের বিরোধিতা করতেনএটা করতে গিয়ে বিষয়টি এমন জায়গায় দাঁড়িয়ে যায় যে তিনি প্রায় বিজ্ঞানবিরোধী একটা অবস্থানে চলে যানতবে উনি একা নন, পোস্টমর্ডার্ন পোস্ট কলোনিয়াল বুদ্ধিজীবীরা প্রায় সকলেই এরকম একটা বিজ্ঞান বিরোধী অবস্থান নিয়ে থাকেন

পুরোটা না হলেও আমাদের আলোচ্য বিষয়টা অনেকটা এই রকমমার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ অবশ্যই কমিউনিস্ট পার্টির দর্শনকিন্তু এটি এর প্রথম সংজ্ঞা নয়, এবং সেই জন্য দেখা যাবে মার্ক্স, এঙ্গেলস, এমনকি লেনিনের লেখায় এমন বয়ান পাওয়া যাবে নাএঁদের স্টেটমেন্টে এরকম কিছু আছে, যেমন মার্ক্স একটা জায়গায় বলছেন: “Just as philosophy finds its material weapon in the proletariat, the proletariat finds its spiritual weapon in the philosophy.” [Marx 1981, 52] এই কথাটার মধ্যে মার্ক্স যেটা বলতে চাইছেন, জ্ঞান-বিজ্ঞান দর্শন যত এগোবে, ততই সর্বহারা শ্রেণির স্বার্থের সাথে তার বন্ধন সাযুজ্য বাড়বেআবার উল্টোদিক থেকে, সর্বহারা শ্রেণি যত এগোতে থাকবে, তার লড়াইয়ের জন্য যে জ্ঞান-বিজ্ঞান দর্শন দরকার হবে, নতুন দর্শনের মধ্যে সেই নির্দেশিকাটা সে পাবেফলে এই প্রকাশভঙ্গিগুলো আর একটু সতর্কভাবে উপস্থাপন করা উচিতস্তালিনের উদ্ধৃতিটি সোভিয়েত পার্টির ক্ষেত্রে বিপ্লবোত্তর সমাজে হয়ত সত্য, কিন্তু সার্বিকভাবে মার্ক্সবাদ ব্যাখ্যা করার সময় এটি কখনও কখনও ক্ষতিকারক হয়ে উঠতে পারে

বিপত্তিটা কোন দিক থেকে আসে দেখা যাক

মরিস কর্নফোর্থ এই ক্লাসগুলো নিয়েছেন ১৯৫০ সালে, বইটি প্রকাশিত হয়েছে ১৯৫৩ সালেতারপর বইটার প্রচুর সংস্করণ হয়েছে এবং সারা পৃথিবী জুড়ে, ইংরেজি ভাষাভাষী দুনিয়াতে তো বটেই, এর অনুবাদ হয়েছে এবং এটি বহুল ব্যবহৃত বইবইটির মধ্যে উনি মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন, মাও-সে-তুং সবাইকে সামনে রেখে উদ্ধৃতি দিয়ে বইটিকে দাঁড় করিয়েছেনবইটি সেই অর্থে অত্যন্ত ভালোআমেরিকার একজন প্রসিদ্ধ মার্ক্সবাদী লেখক জন হফম্যান স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, “His 3-volumed Introduction to Dialectical Materialism in particular provided an exposition of Marxist philosophy in lively and readable form, and although the quotations from Mao and Stalin (even in the 4th revised edtion of 1968) seem somewhat dated, even today the volumes are an invaluable aid to those making a first acquantance with the philosophical basis of Marxism.” [Hoffman 1984] এছাড়াও ওনার অনেক ভালো ভালো কাজ আছে; বিজ্ঞানের দর্শনের উপর Science versus Idealism (১৯৫৫) নামে একটি ভালো বই আছেপরে প্রত্যক্ষবাদের সমালোচনায় লিখেছেন Marxism and the Linguistic Philosophy (১৯৬৫/৬৭); কার্ল পপারের মার্ক্সবাদ সমালোচনার একটা দুর্দান্ত জবাবি বই আছে, Open Society and the Open Philosophy (১৯৬৭); ইত্যাদিঅথচ, দুঃখের কথা হচ্ছে, সেই মরিস কর্নফোর্থ নিজে শেষ পর্যন্ত জীবনের প্রান্ত বেলায় পৌঁছে ১৯৭৫ সালে মার্ক্সবাদ কার্যত পরিত্যাগ করে বসলেনঘটনাটা আমরা অনেকেই আজও জানতে পারিনি; আর যাঁরা জানেন তাঁদের কাছেও এর কারণ সংক্রান্ত কোনো সদুত্তর নেই

মুশকিলটা হচ্ছে, এই যে উপলব্ধির জায়গাটা, অর্থাৎ, শ্রমিক শ্রেণির একটা দর্শন আছে, শ্রমিক শ্রেণির দল হিসাবে কমিউনিস্ট পার্টির একটা দর্শনের প্রয়োজন আছে, আর কমিউনিস্ট পার্টির দর্শন বা শ্রমিক শ্রেণির দর্শন—এই দুটো কথার মধ্যে যে পার্থক্য, এটা যদি স্পষ্ট না হয় তাহলে কী হবে? সমস্যাটা কোথায়? সবাই জানেন, স্তালিনের মৃত্যুর পর নিকিতা খ্রুশ্চভ নেতা হিসাবে উঠে এলে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৫৬-৫৭ সালের পর থেকে রাজনৈতিক লাইন বদলাতে থাকেতখনও সে মার্ক্সবাদের কথাই বলছে, কমিউনিজমের কথাই বলছে, মার্ক্সবাদের উপর ভালো ভালো বইপত্রও প্রকাশ করছেকিন্তু একই সঙ্গে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় তার বক্তব্য পাল্টে যাচ্ছেতাহলে সেটাও কি মার্ক্সবাদী দর্শন? তখনও পার্টিটা একটি মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী পার্টি, তখনও পার্টি পুরোপুরি উচ্ছন্নে যায়নি, কিন্তু তার বক্তব্যে অনেক পরিবর্তন এসে যাচ্ছেসে যে দর্শনটির প্রতিনিধিত্ব করছে, সেটা কি ঠিক? এই যে সমস্যা, সেটার সমাধান কেউ করতে পারেনিফলে আসলে সেই দলটা মার্ক্সীয় দর্শন থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছে, সংশোধনবাদের রাস্তায় পা বাড়িয়েছেএই হচ্ছে সোজা কথাএই করতে করতে কতগুলো ঘটনা ঘটে গেল১৯৫৬ সালে যখন হাঙ্গেরিতে একটা প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থান হল, সেটাকে দমন করার জন্য সোভিয়েত রাষ্ট্রকে সেনা পাঠাতে হলতারপর ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় আর একটা সমাজতন্ত্র বিরোধী অভ্যুত্থান হল, সেখানেও সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনাবাহিনীকে পাঠিয়ে হস্তক্ষেপ করতে হলএই যে ঘটনাগুলো ঘটছে, তার ব্যাখ্যা কী? সেটার ব্যাখ্যা ঠিক মতো হচ্ছে নাশুধু প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থান হচ্ছে বললেই তো হবে না; হচ্ছে কেন, তারও ব্যাখ্যা করতে হবেসোভিয়েতের সঙ্গে থেকে একটা শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র চেকোস্লোভাকিয়া, যা একটা শিল্পোন্নত দেশ—ওই রকম একটা দেশে কেন প্রতিবিপ্লব হবে? কেন সমাজতন্ত্র লোকে পরিত্যাগ করতে চাইবে? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাচ্ছে নাব্রিটেন সহ পৃথিবীর অনেক দেশেই এই প্রশ্ন উঠছে, কিন্তু উত্তর সহজ লভ্য হচ্ছে না

চিনেরও তখন রঙ বদলানোর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছেমাও সে-তুং বেঁচে থাকলেও তিনি তখন খুবই অসুস্থঅনেক কাজই তিনি আর নিজে নিজে করতেও পারেন না, দলের সমস্ত কর্মকাণ্ডের উপরে নিয়ন্ত্রণও রাখতে পারেন নাসেখানে ১৯৭১ সালে হেনরি কিসিঙ্গার রিচার্ড নিক্সনের আকস্মিক ভ্রমণের পর যেভাবে চিনের সঙ্গে আমেরিকার রাতারাতি বাণিজ্যিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে গেল, তাইওয়ানকে হঠিয়ে লাল চিন রাষ্ট্রসঙ্ঘে স্বীকৃতি এবং নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ পেয়ে গেল, সেটাও খুব সহজপাচ্য ব্যাপার ছিল নাকর্নফোর্থের মতো জ্ঞানী সংবেদনশীল মানুষের মনে নানা রকম সন্দেহ জাগবেই, প্রশ্নও উঠবেইআমরা অনেকেই সেকালে এর মধ্যে চিনের কাছে আমেরিকার পরাজয় স্বীকারের ছবি দেখে শুরু শুরুতে আহ্লাদিত হয়েছিকিন্তু অচিরেই মাও-উত্তর চিনের ঘটনাবলি দেখিয়ে দিয়েছে, সেই সব সন্দেহ বা প্রশ্নের কোনোটাই অমূলক বা নিরাধার ছিল না

এই সব প্রশ্নের গ্রহণযোগ্য উত্তর না পাওয়ার ফলে, ১৯৭৫ সালে এসে মরিস কর্ণফোর্থ মার্ক্সবাদ সম্পর্কে সংশয়াবিষ্ট হয়ে পড়েন এবং ১৯৭৬ বা ১৯৭৭ সালে তিনি Communism and Philosophy: Contemporary Dogmas and Revisions of Marxism এই নামে একটি বই লেখেন [Cornforth 1976] এটি তাঁর মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ বা কমিউনিস্ট দর্শনের উপর সমালোচনা, যার মাপকাঠি হচ্ছে প্রয়োগমূলক রাজনীতিকে ধরে, অর্থাৎ, রাশিয়া কী ভুল করল, চিন কীভাবে সরে গেল—এই ধরনের সমালোচনাএই যে জায়গাটিতে উনি গেলেন, এখানে তারা ভুল করছে বলে মনে করলেন, তার জন্য উনি যে দীর্ঘদিন ধরে অন্যদের মার্ক্সবাদ বুঝিয়ে এসেছেন এবং মার্ক্স, এঙ্গেল্‌স, লেনিন, স্তালিন, মাও থেকে অসংখ্য প্রাসঙ্গিক উদ্ধৃতি দিয়ে এসেছেন, সেগুলো তো সঙ্গে সঙ্গে ভুল হয়ে যাওয়ার কথা নয়তাহলে উনি নিজেকে কেন রক্ষা করতে পারলেন না? এই যে না পারাটা, এতে বোঝা যায়, দর্শনের জায়গাটাকে কোথাও ঠিকঠাক বোঝা হয়নিযেমন করে বুঝলে পরিস্থিতির যতই পরিবর্তন হোক, অন্যরা যাই ভুল করুক, আমার উপলব্ধিটা আমি ছাড়তে পারব না—সেই অবস্থায় থাকা সম্ভব হত। 

ব্যাপারটা অনেকটা এরকম: একটি অনুকূল পরিবেশে আমার প্রিয় দল এবং সেই দলীয় দর্শন সফল হচ্ছে, তখন আমি ওই দর্শন মেনে চলছিযখন এই অনুকূল অবস্থাটা নেই, প্রতিকূলতা এসে গেল, সেই দল এবং দর্শন সাফল্যের মুখ দেখছে না এবং সমস্যা হচ্ছে, তখন আমি আর তার সমর্থক নইকিংবা, দলেরই তো দর্শনদলটা পচে গেল, তার মানে দলের দর্শনটাও বাতিলযোগ্য হয়ে গেলস্তালিন প্রদত্ত এবং কর্নফোর্থ গৃহীত সংজ্ঞাটার এইগুলি হচ্ছে সীমাবদ্ধতাঅথচ, আসল বিচারটা এরকম হওয়া উচিত ছিল: সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি এবং অন্যান্য কমিউনিস্ট পার্টি দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের দর্শনকে বহন করছেআমিও তাকে সত্য হিসাবে গ্রহণ করেছিচার দিক থেকে বুঝে শুনেইফলে সেই সব দল যদি সেই দর্শনকে একটু একটু করে ছেড়েও দেয়, নীতিভ্রষ্টও হয়, আমি সত্যের পতাকাকে ছাড়ব নাতা যদি না হয়, তার অর্থ, মার্ক্সবাদ সম্পর্কে চেতনার এই দৃঢ় ভিত্তি সেদিন স্থাপিত হয়নি

আমার ধারণা, এর সাথে মার্ক্সবাদ প্রয়োগের ক্ষেত্রে আরও কতগুলো আপসের ঘটনা আছেযেমন, মরিস কর্ণফোর্থের আমাদের ব্যবহৃত প্রথম সংস্করণের বইটিতে বা অন্যত্রও লাইসেঙ্কোর বিষয়ে কোনো সমালোচনা তো নেইই, বরং ঘুরিয়ে খানিকটা সমর্থনই করা হয়েছিল[Cornforth 1979, 68] দেখে আমরা বেশ অবাক বোধ করিএরকম কেন? কারণ,মনে হয়, তখনও পর্যন্ত তাঁদের অবস্থান ছিল, সোভিয়েত রাশিয়া যদি কিছু ভুলভালও বলে, আমরা সেটা বাইরে প্রকাশ করব না, উলটে আমরা সেই ভুলকেই নানা ভাবে সমর্থন করে যাব, বাঁচানোর চেষ্টা চালাবযদি কেউ বলেন যে এর পেছনে ছিল স্তালিন আমলের জবরদস্তি, তাতেও বিষয়টা বোঝা যাবে নাকেন না, বইটি প্রকাশিত হয়েছে স্তালিনের মৃত্যুর পরহ্যাঁ, এটা ঠিক, খ্রুশ্চভও যত দিন পেরেছে লাইসেঙ্কোকে মাথায় তুলে রেখেছিলখ্রুশ্চভের পতনের পরই লাইসেঙ্কোরও পতন হয়তখন, ১৯৬৪ সালের পরে, বইটার শেষ (চতুর্থ) সংস্করণে (১৯৬৮) উনি খুব সন্তর্পনে (সম্ভবত, বেশ অনিচ্ছা সহ) কয়েকটি সমালোচনামূলক বাক্য যোগ করেন [Cornforth 1978, 76] এবং ভূমিকায়ও সেটার উল্লেখসহ ভুল স্বীকার করেন [Ibid, 4] অন্য দিকে, বইটার ৪র্থ সংস্করণ লন্ডন এবং নিউ ইয়র্কে প্রকাশিত হলেও আমাদের দেশে সিপিআই(এম)-এর তরফে ন্যাশন্যাল বুক এজেন্সি থেকে বইটার সেই প্রথম সংস্করণেরই পুনর্মুদ্রণ হতে থাকে, এবং তার ফলে আমরা এখানে যে সংস্করণটি (১৯৭৯) ব্যবহার করেছি, তাতেও মনে হবে, কর্নফোর্থ বরাবরই লাইসেঙ্কো তত্ত্বকে সমর্থন করে এসেছেনকমিউনিস্ট পার্টিগুলির তরফে বিজ্ঞানের জগতে একটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত চিন্তাকে বাঁচিয়ে রাখার কী অদ্ভুত প্রয়াস!

আবার, ইন্টারনেট থেকে দেখা যাচ্ছে, প্রথম খণ্ডের ৪র্থ সংস্করণের ভূমিকায় মরিস কর্নফোর্থ জানিয়েছেন, তিনি আদি বইটির মূল পাঠে কিছু কিছু সংস্কার সাধন করলেও এবং স্তালিন এবং মাও সম্পর্কে আগেকার ধারণার বদল হলেও, তাঁদের উদ্ধৃতিগুলিকে বাদ দেননি, কেন না, তিনি মনে করেন, মার্ক্সবাদ বোঝার ক্ষেত্রে সেই উদ্ধৃতিগুলির এখনও কার্যকারিতা রয়েছেঅথচ, আমরা বইয়ের প্রথম যে বাক্য নিয়ে এত কথা বলেছি, স্তালিনের উদ্ধৃতি সহ সেই বাক্যটিই তিনি সেখানে পালটে দিয়েছেন এবং সাবজেক্ট প্রেডিকেটের সমস্যা দূর করে ফেলেছেনসেটা কোথাও স্বীকার করলেন নাএর মধ্যেও দেখা গেল, তাঁর ঘোষণার সঙ্গে কাজের একটা অসঙ্গতিসংশোধনটা সঠিক হলেও প্রক্রিয়াটা ভালো হল নাশুরুতেই বলে নেওয়া উচিত ছিল যে মার্ক্সীয় দর্শন সংজ্ঞাদানের ক্ষেত্রে আমরা প্রথম সংস্করণের একটা ছোট ভুল শুধরে নিয়েছি

এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে, জে ডি বার্ণাল মারা যাওয়ার সময় পর্যন্ত লাইসেঙ্কোর ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য মন খুলে লিখতে পারেননিতাঁর Science in History ১৯৫৪ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় এবং ওই বইটির অনেকগুলো সংস্করণ হয়েছেষাটের দশকে তাঁর ওই এক খণ্ড বই বর্ধিত কলেবরে চার খণ্ডে প্রকাশিত হয়তখন নাকি কেউ কেউ প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে লাইসেঙ্কোর এপিসোডটা এবার অন্তত আলোচনায় আনা হোকউনি কিঞ্চিৎ উত্থাপন করেছেন, কিন্তু লাইসেঙ্কোর ভুল, তার পেছনে স্তালিনের তথা দলের পূর্ণ মদত এবং জেনেটিক্স গবেষকদের হেনস্থার ঘটনা কোথাও উল্লেখ করেননিকেন নেই? ওনার মনে হয়েছিল সোভিয়েত রাশিয়ায় স্তালিনের সময় বিজ্ঞানের প্রশ্নে এরকম একটা বিরাট আকারের ভুল হয়েছে বললে সমাজতন্ত্রের সম্মান চলে যাবেভুলটা যে বিজ্ঞানের দিক থেকে, সেটা তো বলাই উচিৎ, যেখানে ওনার বইটাও বিজ্ঞান বিষয়ে

প্রসঙ্গত বলা দরকার, বার্নালের মেয়ে এক সময় বলেছেন, আমার বাবা শেষ দশ বারো বছর প্রচণ্ড মেলানকোলিয়ায় ভুগতেনকেন মেলানকোলিয়া? একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী প্রচণ্ড শক্তিশালী মেধাবী চিন্তাবিদ হিসাবে বার্নালের মেলানকোলিয়া হওয়ার কথা নয়রাজনৈতিক পরিস্থিতি প্রতিকূল হলে দুঃখ পেলেও তাঁর মানসিক সঙ্কট হওয়ার কথা নয়তবুও হল কেন? কারণ, তাঁকে আপস করতে হচ্ছেসব কিছু জেনেও সত্যকে আড়াল করতে হচ্ছে, যা তিনি ভেতর থেকে মেনে নিতে পারছেন নাবলতে চান, কিন্তু এক জাতীয় স্ব-আরোপিত রাজনৈতিক বাধ্যতার কারণে বলতে পারছেন নাএই সমস্যাগুলোর কিছুটা ভিত্তিমূল, সবটা না হলেও, আমরা তাঁদের লেখা এই বইগুলোতে টের পাইআগে না হলেও এখনকার জটিল সময়ে এগুলো বোঝা যাচ্ছেমার্ক্সবাদ-লেনিনবাদকে যে জায়গা থেকে বুঝলে, পরিস্থিতি যাই হোক আমি তা পরিত্যাগ করব না—এভাবে বোঝাটা হয়নিযেমন, বিজ্ঞানটাকে আমরা এমনভাবে বুঝব যে এটি বিজ্ঞান, এটি ঠিক, অন্যদের যা মনে হচ্ছে সেটা ঠিক নয়; তাহলে পরিস্থিতি অন্য রকম হলে আমরা সেগুলোকে অ্যান্টি-সায়েন্স বলবউদাহরণ হিসাবে, এখন আমাদের দেশে যাঁরা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানে বা আইআইটি-তে আছেন তাঁদের সমস্যা হচ্ছে, কিছু করতে হলেই গরু নিয়ে বা গরুর পেচ্ছাব গোবর নিয়ে কাজ করতে হবে, তার বাইরে কিছু করা মুশকিলকেন্দ্রীয় সরকার ফাণ্ড দেবে নাএতে কি বিজ্ঞানের কোনো অধ্যাপক যিনি ফিজিক্স বা কেমিস্ট্রি ইত্যাদি পড়ান, তাঁর সাবজেক্টে আস্থা হারিয়ে ফেলবেন? ভুলে যাবেন সব? এটা দেখা যাবে, হবে নাতাঁদের প্রবলেম হবে চাকরি জীবনে, নানা রকম ঝঞ্ঝাট হবেকিন্তু তাঁরা আশা করি তাঁদের বৈজ্ঞানিক অবস্থান ধরে রাখবেনবিজ্ঞান তো এইটাই, ওটা বিজ্ঞান নয়এটা স্বৈরাচারী সরকার জবরদস্তি আমাদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছেযেটা ঠিক নাএই রকম উপলব্ধির জায়গায় বার্নাল বলুন, কর্নফোর্থ বলুন, তাঁদের মনে হয় একটা সমস্যা ছিল ধরনের বইগুলো স্টাডি করার সময় এটা আমাদের এখন থেকে মাথায় রাখতে হবেআমাদের বক্তব্যের মধ্যে যাতে এরকম কোথাও কোনো ফাঁক না থাকে, যথাসম্ভব সতর্ক থাকতে হবে

আমরা প্রথমে মার্ক্সবাদকে আজকের যুগের শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক দর্শন হিসাবে গ্রহণ করবকর্নফোর্থের পরবর্তী কালের ভাষায়: “Thus dialectical materialism is in the truest sense a popularphilosophy, a scientific philosophy and a philosophy ofpractice.” [Cornforth 1978, 15] একই সঙ্গে বলব, এ হচ্ছে বর্তমান যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বৈপ্লবিক মতবাদ, সঠিক ভাবে বুঝলে সমাজ পরিবর্তন এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের একমাত্র মতাদর্শিক হাতিয়ার, এবং শ্রমিক শ্রেণির দর্শনএকটি কমিউনিস্ট পার্টিও এই দর্শনকেই হাতিয়ার করে চলে

পরিশেষে আর একটি কথা পাঠকদের উদ্দেশে বলে রাখিআমরা নতুন অভিজ্ঞতা নতুন পরিস্থিতির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বর্তমান পর্যালোচনাটিকে তৈরি করলেও এটা কোনোভাবেই মরিস কর্নফোর্থ বা সোভিয়েতের বই দুটোর বিকল্প হিসাবে রচিত হয়নিসেই বইগুলির (এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক গ্রন্থের) উপযোগিতা এখনও আছে এবং তা এক দিকে মার্ক্সবাদের উপলব্ধি নির্মাণে যেমন সাহায্য করবে, একই সঙ্গে সেই উপলব্ধির বিভিন্ন স্তরগুলিকে সনাক্ত করণেও কাজে লাগবে

     গ্রন্থসূত্র :

Maurice Cornforth (1976), Communism and Philosophy: Contemporary Dogmas and Revisions of Marxism; Lawrence Wishart & Co., London.

Maurice Cornforth (1978), Materialism and Dialectical Method (Volume One of the 3-volume Dialectical Materialism: An Introduction); International Publishers, New York (4th Edition).

Maurice Cornforth (1979), Dialectical Materialism: An introductory course; National Book agency, Kolkata (3rd Edition).

John Hoffman (1984), “An Appreciation of Maurice Cornforth: Personal Reminiscences of a Critical Admirer”; Bulletin of the Marx Memorial Library, Vol. 105 No. 1 December 1984.

Karl Marx (1981), “Contribution to the Critique of Hegel’s Philosophy of Law: Introduction”; in Karl Marx and Frederick Engels (1981), On Religion; Progress Publishers, Moscow.

J. V.Stalin (1949), Dialectical and Historical Materialism;  Foreign Languages Publishing House, Moscow.

 

 

                                প্রথম অধ্যায়: মার্ক্সবাদের বৌদ্ধিক উদ্ভব 

পটভূমি

মার্ক্সবাদী দর্শনের উপর আলোচনা করতে হলে প্রথমে আমাদের দেখতে হবে, কার্ল মার্ক্স এবং ফ্রেডরিক এঙ্গেল্‌স কীভাবে এই মতবাদের দোরগোড়ায় পৌঁছলেনতাঁরা তো আর শুরু থেকেই মার্ক্সবাদী ছিলেন না বা হননিতাঁদেরও চিন্তার বিকাশের একটা ইতিহাস আছেউদ্ভিন্ন যৌবনে বিভিন্ন মতাদর্শের ভেতর দিয়ে বুদ্ধি চিন্তার পরিপক্বতা অর্জনের পথেই তাঁরা এক সময় তাঁদের কমিউনিস্ট ভাবধারায় উপনীত হনসেই ইতিহাসের ভিত্তিতে আমাদের বোঝা দরকার কীভাবে এই মার্ক্সবাদ গড়ে উঠেছিল

ইতিহাসের সেই খণ্ডচিত্রটা খুবই চমকপ্রদমার্ক্স জন্ম নিয়েছেন ১৮১৮ সালেএঙ্গেলসের জন্ম ১৮২০-তেএবং ১৮৪৪ সালে যখন তাঁদের দুজনের ভালো করে দেখা হচ্ছে তখন তাঁরা দুজনে দুরকম রাস্তায় দুরকম জীবনের পথে কিন্তু একই রকম চিন্তায় পৌঁছে গেছেনএটা কী করে হল? অর্থাৎ, এঙ্গেলস মার্ক্সের একটা পত্রিকার জন্য লেখা পাঠিয়েছিলেন, লেখাটার নাম হচ্ছে “Outlines of a Critique of Political Economy”মানে, পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে তিনি ব্যাখ্যা করছেনএটা একটা খুবই ছোট আট-দশ পাতার প্রবন্ধ, কিন্তু এই প্রবন্ধটার মধ্যে পরবর্তীকালের মার্ক্সবাদী অর্থনীতির যে বক্তব্য, তার অনেকটাই আছে এবং মার্ক্স পড়ে দেখছেন যে তিনি নিজেও ইতিমধ্যে যা বলতে চান সেই কথাগুলোই এই যুবক বলে ফেলেছেন

১৮৪৪ সালে মার্ক্সের বয়স ২৬ আর এঙ্গেলসের বয়স ২৪মার্ক্সের যাত্রাপথ হচ্ছে এই রকম: স্কুল থেকে বেরিয়ে তাঁর বাবার পরামর্শে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছিলেনজার্মানিতে তখন ওকালতি একটি মোটামুটি নিরাপদ পেশা ছিলঅর্থাৎ, তুমি যাই করো, রুজি-রোজগার করে বেঁচে থাকতে পারবেঅধ্যাপক বা অন্য কোনো পেশা হলে সেটা নিরাপদ নয়তোমার মতামত র‍্যাডিক্যাল হলে চাপ বাড়তে থাকবেসেজন্যে মার্ক্সের বাবা চেয়েছেন, ছেলে আইন নিয়ে পড়ুকআবার আইন পড়তে পড়তেই তিনি দর্শন নিয়েও পড়াশোনা করেছেনতারপর তিনি গবেষণা করে যে থিসিস জমা দিয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন, সেই ডক্টরাল ডিসারটেশনটাও দর্শন নিয়েতার পর এক সময় হেগেল’স ফিলোজফি অফ নিয়ে লিখতে শুরু করেনওনার ১৮৪৩ সালের একটা অসম্পূর্ণ লেখা আছে “Critique of Hegel’s Philosophy of Right” শিরোনামেযে প্রবন্ধের ভূমিকার মধ্যে তাঁর ধর্ম সংক্রান্ত বিখ্যাত “দীর্ঘশ্বাস” বাচক মতামতগুলো পাওয়া যায়তার মানে, মার্ক্স আসলে তখন এগিয়ে চলেছেন দর্শন শাস্ত্রের দিক থেকেতিনি বুঝতে চাইছিলেন, সমাজ বদলাতে হলে এখন আমাদের দর্শনটা কেমন হওয়া দরকার

এঙ্গেলসের ক্যারিয়ার আবার এত চমকপ্রদ নয়ফ্রেডরিক যখন স্কুলের ছাত্র ছিলেন, তাঁর ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার আগেই, তাঁর বাবা তাকে জোর করে ১৮৩৮ সালে তাঁদের পারিবারিক মালিকানাধীন এক কারখানায় কেরানির পদে বসিয়ে দেনএঙ্গেলসকে সেখানে কাজ করতে বসিয়ে দেওয়া হয় দুটো কারণেআসলে এই সব ছেলেদের মতিগতি বাপ মায়েরা ঠিক বুঝতে পারেএঙ্গেলসকে দেখেই বাবা সন্দেহ করেছিলেন যে ওর অবস্থা ভালো ঠেকছে নাযে কোনো দিন জার্মানির যেগুলো সিক্রেট সোসাইটি তাদের কোনোটায় সে ভিড়ে যাবেএদিকে কারখানায় বসেও এঙ্গেল্‌স তাঁর “আপত্তিকর” কাজগুলো চালিয়ে যাচ্ছিলেন১৮৪১ সালে তিনি সামরিক বিভাগে যুক্ত হয়ে বছর খানেক মিলিটারি ট্রেনিং নেনতার পর ১৮৪২ সালে তাঁর বাবা তাঁকে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে পাঠিয়ে দিলেনসেখানে এক বস্ত্র কারখানায় তাঁদের প্রচুর শেয়ার ছিলবাবা চেয়েছিলেন, ছেলেকে বসিয়ে দিলে শেয়ারটা ঠিকঠাক খাটছে কিনা, কেউ ঠকাচ্ছে কিনা—এগুলো বোঝা যাবেআর দুনম্বর হচ্ছে, এই সুযোগে তিনি ওকে জার্মানির থেকে বের করে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেনভদ্রলোক ছিলেন খুব দাপুটেমানে, এঙ্গেলসরা খুব ভয়টয় পেতেনমনে মনে অপছন্দ হলেও বাবার দাপটে এঙ্গেলস না করতে পারেননিঅনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁকে ইংল্যান্ডে চলে যেতে হয়কিন্তু ওই যে বলে না—অঙ্গারং শত ধৌতেন . . ., ইত্যাদি, সেই ম্যানচেস্টারে গিয়েও তাঁর স্বভাবটা একই রকম থাকেওখানেও তিনি সারা দিনের অফিসের কাজ শেষ করে মজুরদের বস্তিতে বস্তিতে ঘুরতেনএখানে ওখানে তাদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতেনএবং এই করতে করতে এবং ওই আউটলাইন লেখার সাথেই একটা বড় বইও লিখে ফেললেন: Condition of the Working Class in England, অর্থাৎ, ইংল্যান্ডের শ্রমিকদের অবস্থাএই বইটা ইংল্যান্ডের শ্রমিকদের অবস্থার শুধু একটা বিবরণ মাত্র নয়তার মধ্যে একটা তত্ত্ব দেওয়ার চেষ্টা আছেকেন শ্রমিক শ্রেণির অবস্থাটা এত খারাপ? কেন তারা উপযুক্ত স্বাস্থ্য শিক্ষা থাকার জায়গা পানীয় জল জল নিকাশি ব্যবস্থা ইত্যাদি পাচ্ছে নাএর একটা সামাজিক রাজনৈতিক ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা ওতে আছেধনতন্ত্রের স্বরূপ উন্মোচনের একটা প্রয়াস ওতে ছিলএই থিওরির দিকে নজর ছিল বলেই ওই একই সময় তিনি লিখেছেন উপরে কথিত ছোট প্রবন্ধটি

আবার এটাও লক্ষণীয়, মূল ইউরোপ ভূখণ্ড থেকে তিনি অনেক দূরে থাকলেও কোথায় কী পত্রিকা বের হচ্ছে, জার্মানিতে ফ্রান্সে, তার খবর ঠিক রাখতেনএখনকার মত না হলেও, তখনকার মতো করে, খবর কিন্তু এসে গেছে যে পারি শহর থেকে এরকম একটা পত্রিকা বার হচ্ছেযিনি সম্পাদনা করছেন, কার্ল মার্ক্স, তাঁকে তিনি ভালো করে চেনেন নাপরিচয় নেইশুধু জেনেছেন, ইনি খুব বিজ্ঞ লোক, ইতিমধ্যেই বেশ খ্যাতি অর্জন করেছেন এবং র‍্যাডিক্যাল মনোভাবাপন্নফরাসি-জার্মান বার্ষিকী নামে একটা র‍্যাডিক্যাল পত্রিকা বেরচ্ছে, এই খবরটা পেয়ে সেখানে একটা প্রবন্ধ পাঠিয়ে দিয়েছেনএইভাবে এঙ্গেলস সরাসরি শ্রমিক শ্রেণির সঙ্গে মিশে, তাদের সমস্যাকে প্রত্যক্ষভাবে বুঝে, তাদের অর্থনৈতিক সামাজিক সমস্যাটাকে ধরতে গিয়ে আস্তে আস্তে এগোচ্ছেন১৮৪৪ সালে মার্ক্সকে তখন জার্মানি থেকে বিতাড়িত করা হয়েছেতিনি তখন পারিতে, ইতিমধ্যে বিয়ে করে ফেলেছেন জেনিকেওখানে কিছু বন্ধুবান্ধবকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করছেনকিছু পত্রিকা বের করা যায় কিনা এসব ভাবনা চলছেএরকম একটা সময়ে মার্ক্সের ওই প্রবন্ধটা পড়ে খুব ভালো লাগেএঙ্গেলসকে চিঠি লেখেন, যে তুমি এদিকে এলে পারিতে এসে আমার এই ঠিকানায় দেখা কর

এঙ্গেলস সেই বছরের আগস্ট মাসে চলে এলেন এবং দশ দিন মার্ক্সের বাড়িতে ছিলেন হচ্ছে, জন রিড যেটা পরে লিখেছেন, দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন, তার প্রায় এক শতক আগে দুনিয়া কাঁপানোর দশ দিনের এক দুর্দান্ত রিহার্সালদুজনে পাশাপাশি বসে, মার্ক্স দর্শনের দিক থেকে যা যা উপলব্ধি করেছেন সেটা আলোচনা করেন; আর এঙ্গেলস তাঁর নিজের কারখানা ভিত্তিক অভিজ্ঞতা বলতে থাকেনএবং তারপর দেখা যায়, দুজনের মিল এমনই যে, দুজনেই গ্রিক সাহিত্য ভালবাসেন; দুজনেই বিভিন্ন দেশের ক্লাসিক্যাল মিউজিক ক্লাসিক্যাল সাহিত্য পছন্দ করেনএর বাইরে আবার নানা রকম বৈচিত্র্যও আছেকার্ল হচ্ছেন খাঁটি ইহুদি পরিবারের সন্তান; ফ্রেডরিক নির্ভেজাল নর্ডিক জার্মানমার্ক্স অনেক বেশি গুরুগম্ভীরজ্ঞান সমুদ্রে গভীরের ডুবুরিএঙ্গেলস অনেক বেশি দিলখোলা হই-হুল্লোড়েহাসতে ভালবাসেন, ঘোড়ায় চড়তে ভালোবাসেন, বন্দুক সম্বন্ধে উৎসাহীজ্ঞানের মাঝ সমুদ্রে গিয়ে জাহাজ বাইতে চানএকটা রাজকীয় ব্যাপার তাঁর আছেএরকম করে দশ দিন হেসে খেলে কথা বলে তর্ক করে ধোঁয়া উড়িয়ে এক সঙ্গে কাটিয়ে যখন এঙ্গেলস ফিরে যাচ্ছেন, তখন তাঁরা তাত্ত্বিক দিক থেকে একটা চিন্তাগত ঐকমত্যে পৌঁছে গেছেন

তারপর তাঁরা ঠিক করে নেন, আমাদের নিজেদের এই ভাবনা চিন্তাগুলোকে লিখতে হবেএতদিন তারা আলাদা আলাদা লিখেছেনএবার ১৮৪৫ সালে ওনারা একটা লেখা একসাথে লিখতে শুরু করলেন

এই জায়গাটা আমাদের পরিষ্কার করে বুঝে নেওয়া দরকার

মার্ক্সবাদ অভিমুখে যাত্রাপথ

প্রথমত, দর্শনের দিক থেকে মার্ক্সের উপর প্রথম যে প্রভাবটা পড়েছে সেটা হচ্ছে হেগেলের প্রভাবগোটা জার্মানিতেই তখন হেগেল খুব পপুলারহেগেলের দর্শনের ব্যাপক প্রভাবের প্রধান কারণ হচ্ছে, আইডিয়ালিস্ট হওয়া সত্ত্বেও হেগেল ছিলেন একজন অসাধারণ বিদ্বান ব্যক্তিজ্ঞান বিজ্ঞানে তাঁর সমকালে প্রায় এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যার মধ্যে তিনি ঢোকেননিমানে, পদার্থবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত থেকে শুরু করে ধর্ম, ইতিহাস, দর্শন, আইন, সাহিত্য, এরকম নানান বিষয়ে তিনি ঢুকেছেন, এমনকি নন্দনতত্ত্ব, থিওরি অব লিটারেচার, তার উপরেও তাঁর লেখা আছে, বই আছে এবং সেই বইগুলো যথেষ্ট ভালো বই, ভাববাদী হলেওআজ অবধিও তাদের জ্ঞানমূল্য বিদ্যমানদু নম্বর হচ্ছে, ভাববাদী হলেও হেগেলের দর্শনের বয়ানটা এমন যে, কোনো একটা পর্যায় থেকে তা আর ভাববাদী থাকে না, সে যখন বিভিন্ন পরিঘটনা নিয়ে আলোচনা করে তখন তাকে বস্তু বা বস্তুভিত্তিক ধরে নিয়েই চর্চা করেবাস্তব সমাজ ইতিহাস নিয়েই বক্তব্য রাখেঅবশেষে যখন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে গিয়ে পৌঁছায় তখন সে ভাববাদে ফিরে যায়এই যে একটা ব্যাপার, এটাও হেগেলের দর্শনের প্রভাবের একটা বড় কারণআর তৃতীয় কারণ হচ্ছে ডায়ালেকটিক্সঅর্থাৎ যেটা পরবর্তীকালে ডায়ালেকটিক্স বলে পরিচিত হয়ডায়ালেকটিক্সের জন্মদাতা হিসেবে হেগেলের নামটা গুরুত্বপূর্ণ

পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস যাঁরা লেখেন তাঁরা ডায়ালেকটিক্সের সূচনা ধরে নেন গ্রিক দর্শন থেকেহেরাক্লিতাস, আরিস্ততল, এরকম যাঁরা আছেন তাঁদেরকে অনেকে ডায়ালেকটিসিয়ান বলেনতাঁরা যে বলেন তার কারণ হচ্ছে অনেকটা এরকম যে এনারা দর্শনের আলোকে অনেক কিছুকে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করেছেনআর বিকাশের পৃষ্ঠভূমিতে সব জিনিসকে দেখেছেন, মানে সব কিছুই বিকাশমান—এই ভাবে বিচার করতে চেয়েছেনযে কোনো ঘটনার একটা ইতিহাস আছে, তার একটা ক্রমিক বিকাশ হয়েছে—এইভাবে তাঁরা দেখার চেষ্টা করেছেনআমাদের দেশে বৌদ্ধ ধর্মের তত্ত্বেও একটা ডায়ালেকটিক্যাল অ্যাপ্রোচ আছে, এটা অনেকে বলার চেষ্টা করেছেননানা ভাবে রাহুল সাংকৃত্যায়ন এটা একদিক থেকে বলেছেনডি ডি কোসাম্বিও এগুলো বলেছেনপরবর্তীকালে, দেবীপ্রসাদ অতটা না বললেও রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের বিষয়ে বেশ ভালো লেখা আছে, যেখানে উনি দেখাচ্ছেন, কোথায় কোথায় বৌদ্ধ দর্শন দ্বান্দ্বিকএখন এখানেও দ্বান্দ্বিক দর্শনের যে দিকটা বৌদ্ধ ধর্মতত্ত্বে চর্চা হয়েছে সেটা হচ্ছে পরিবর্তনশীলতাআর পরিবর্তনের মধ্যে যে কোনো জিনিসের যে একটা অস্থায়িত্ব, সেটাকে ওরা বলে ক্ষণিক ছন্দবাদমানে, যা আছে, সব এই মুহূর্তে আছে, তারপরে আর নেইযেমন খ্রিঃ পূঃ ষষ্ঠ-পঞ্চম শতকের চিন্তাবিদ হেরাক্লিতাস বলেছেন: একই নদীতে দুবার চান করতে নামা যায় নাআর একজন, সোক্রাতেসের সমকালীন, প্লাতোর অন্য একজন শিক্ষক বলে কথিত দার্শনিক, ক্রাতিলাস নাকি বলেছিলেন যে এক নদীতে একবারও চান করা যায় নানামতে নামতেই স্রোতের কারণে নদী পালটে যায় [Cited, Plekhanov 1976, III; 77] আধুনিক ব্যাখ্যাকাররা এই প্রাচীন দর্শনে দ্বন্দ্ববাদ দেখার সময় এই পরিবর্তনশীলতার উপর জোর দিচ্ছেন

বিষয়ে আমার নিজের একটু সংশয় আছে, এভাবে বলা যায় কিনাআমার ধারণা যে প্রাচীন এই দর্শনগুলোকে বড় জোর এক ধরনের প্রোটো-ডায়ালেকটিক বলা যায়মানে দ্বন্দ্বতত্ত্বের এক একটা কুঁড়ি Proto-dialectics, not dialectics proper! প্রকৃত ডায়ালেকটিক্সের উদ্ভব জার্মানিতেইএবং জার্মানিতে আরও যাঁদেরকে ডায়ালেকটিক্সের আদি প্রবর্তক বলা হয়, যেমন, প্রথম ইমানুয়েল কান্ট, গটলিব ফিকটে এবং তারপর ফ্রিডরিখ শেলিংআর সবার শেষে হচ্ছেন গেওর্গ হেগেলভাববাদের বিকাশে এই চারজনকে ধরা হয় যাঁরা ডায়ালেকটিক্সকে আধুনিক যুগে বিকশিত করেছেনকিন্তু লক্ষ করলে দেখা যাবে, এই চারজনের মধ্যে প্রথম যে তিনজন, তাঁদেরও ডায়ালেকটিক্স কিন্তু ভীষণ কাঁচাকাঁচা কেন? কারণ তাঁদের যে দার্শনিক ভাবধারা, তাতে নতুন কোনো লজিক্যাল টুল নেই, যে টুলটা দিয়ে এই যে পরিবর্তনের ধারাকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা যায়যে সমস্ত গ্রিক দর্শনকে বলা হচ্ছে ডায়ালেকটিক্স, সেই দর্শনের প্রবক্তারাই আবার ফরমাল লজিক-এর জন্মদাতা

ফরম্যাল লজিক অনুযায়ী আরিস্ততল প্রবর্তিত চিন্তার তিনটি মূল সূত্র এখনও বিজ্ঞান দর্শনের জগতে প্রভাব বিস্তার করে রেখেছেএই ফরমাল লজিক বলে: যেটা যা সেটা তা অফ আইডেন্টিটিতার সিদ্ধান্ত হচ্ছে, এটা যা তাকে একই সাথে অন্য রকম বলা যাবে নাআবার বলছে কোন একটা জিনিস এটাও না, ওটাও না—এরকম হবে নাহয় এটা নয় ওটাএই যে সব সূত্রগুলো, এগুলো সবই ফর্মাল লজিক থেকে আসেএই চিন্তাধারা একটা স্থাণু, একটা থেমে থাকা ছবি তুলে ধরেগাছ মানে গাছ, পাখি মানে পাখি, বিড়াল মানে বিড়ালএরকম যে ছবিটা, ফরমাল লজিক তা তুলে ধরেকিন্তু গাছ কী করে চারা থেকে হচ্ছে বা বীজ থেকে চারা, চারা থেকে উদ্ভিদ হচ্ছে—পরিবর্তনের এই ধাপগুলো এই লজিক্যাল টুল দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় নাঠিক একইভাবে কান্ট ফিকটে শেলিং-রাও তেমন ধরনের নতুন লজিক্যাল টুল তৈরি করতে পারেননি যা দিয়ে পরিবর্তনটাকে সাধারণ নিয়মবদ্ধ ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়এই কাজটা প্রথম করলেন হেগেলঅর্থাৎ, হেগেল ডায়ালেকটিক্সকে শুধুমাত্র পরিবর্তনশীলতা আর আন্তর্সংযোগ-- মাত্র এইটুকু বলে থামলেন নাতিনি কিসের ভিত্তিতে সমস্ত কিছু ইন্টারকানেক্টেড, কিসের ভিত্তিতে পরিবর্তন, কীভাবে পরিবর্তনকে বুঝব—ফরম্যাল লজিক থেকে বেরিয়ে এসে এর কতগুলো লজিক্যাল টুল তৈরি করলেনপরবর্তীকালে যেটাকে আমরা থ্রি প্রিন্সিপ্‌লস অফ ডায়ালেকটিক্স বলছিদ্বন্দ্বতত্ত্বের তিনটি সূত্রএই অর্থে হেগেল হচ্ছেন আধুনিক ডায়ালেকটিক্সের জন্মদাতাতাঁর আগে, বুদ্ধই বলুন, হেরাক্লিতাসই বলুন, আরিস্ততলই বলুন—কেউই এরকম দ্বান্দ্বিক বিচারের হাতিয়ার তৈরি করে দিয়ে যেতে পারেননিতবে বলে রাখা ভালো, হেরাক্লিতাস অবশ্য বিরোধের ঐক্যের কথা তুলেছিলেনকয়েকটি চমৎকার উদাহরণও দিয়েছিলেনকিন্তু সেকালে সেসব কথা খুব একটা পাত্তা পায়নিপরে আরিস্ততল এসে সেটাকে বিরোধ সূত্রের বিরোধী বলে বাতিল করে দেনতার পর প্রায় দুহাজার বছর ধরে কান্টের আগে সেই কথা কেউ আর উত্থাপন বা উচ্চারণ করেনি

মার্ক্স এই কথাটাই তাঁর "ক্যাপিটাল"-এর প্রথম খণ্ডে খুব পরিষ্কারভাবে বলেছেনওনার পুঁজি গ্রন্থের প্রথম খণ্ডের একটা বিখ্যাত মুখবন্ধ আছেযদিও সেটার নামটা মুখবন্ধ নয়তিনি এটার নাম দিয়েছিলেন আফটারওয়ার্ডআছে কিন্তু বইয়ের শুরুতেমানে, যেখানে ভূমিকা থাকে, সেখানে আছেকিন্তু লেখাটার টাইটেল হচ্ছে আফটারওয়ার্ড টু দ্য সেকেন্ড জার্মান এডিশনএখন, কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে আফটারওয়ার্ড কেন? কারণ হচ্ছে, ক্যাপিটালের প্রথম খণ্ড বেরনোর পরে বিভিন্ন দেশ থেকে যে প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে, সেই সমস্ত ফিডব্যাকগুলোকে নিয়ে তিনি একটা উত্তর দিয়েছিলেনএই জন্য নাম হচ্ছে আফটারওয়ার্ডএক ধরনের ফিডব্যাক বা ফিরতি জবাবশুদ্ধ ভাষায় আমরা বলতে পারি—পুনশ্চসেখানে মার্ক্স বলছেন, আমি যে আসলে হেগেলের ছাত্র এটা আমি স্পষ্ট করে বলে রাখতে চাইজার্মানিতে এখন অনেকেই হেগেলকে “মৃত ঘোড়া” হিসেবে দেখাচ্ছেকিন্তু আমি মনে করি তা সত্য নয়হেগেলের ভাববাদকে যদি আমরা উল্টে দিই, তা বস্তুবাদের দিকে ঢলে পড়বেওটা এখন মাথার উপর দাঁড়িয়ে আছেতাকে পায়ের উপর দাঁড় করাতে হবেহেগেলের যে ডায়ালেক্টিক্যাল কোর, তার ওপরের ছালটা হচ্ছে ভাববাদীসেই শাঁসটা আমাদের বের করে আনতে হবে

তাহলে হেগেলের যে ডায়ালেকটিক্স সেটা এত গুরুত্বপূর্ণ বলেই কিন্তু পুঁজি গ্রন্থের সেই পুনশ্চতে মার্ক্স এতগুলো কথা বলছেনহেগেল মনে করেছেন, ভাববাদী চিন্তার বিকাশ ঘটতে ঘটতে জার্মানির যে রাজতন্ত্র সেটাই হচ্ছে মানুষের মননশীলতা এবং সভ্যতার শিখরহেগেলের আইডিয়ালিজম বলছে যে জার্মানির যে রাজতন্ত্র, এই রাজতন্ত্র হচ্ছে মানুষের চিন্তার জগতের একটা উৎকর্ষজার্মান রাষ্ট্র হচ্ছে সেই উৎকর্ষের একটা জায়গাফলে এক অর্থে বেশ ভালো রকমের প্রতিক্রিয়াশীল দর্শনআবার হেগেলের যে ডায়লেকটিক্স যার মধ্যে সবই পরিবর্তনশীল, সব কিছুর মধ্যে বিপরীত শক্তি আছে, এই বিপরীত শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্বসংঘাতের ফলে সেগুলোর বিকাশ হচ্ছে পরিবর্তিত হচ্ছে পাল্টে যাচ্ছেআজকে যা আছে সেটা থাকবে না পাল্টে যাবেএই ধারণার মধ্যে বিকাশ এবং পরিবর্তনশীলতার একটা অনিবার্য সাধারণ প্রবণতার কথা বলা হয়েছেআরও অনেক পরে এঙ্গেলস ১৮৮৮ সালে যখন ল্যুদভিগ ফয়ারবাখ বলে একটা বই লিখেছেন সেখানে তিনি দেখিয়েছেন: হেগেল যে ডায়ালেকটিক্স নিয়ে এলেন, তার পরে জার্মানিতে যারা নেক্সট জেনারেশন, ইয়ং জেনারেশন, তারা দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেলএকটা ভাগ হল, তারা যারা হেগেলের দর্শনকে অবলম্বন করে ভাববাদী লাইন ধরে এগোতে চাইছেতারা হয়ে গেল কনজারভেটিভ, প্রতিক্রিয়াশীলএর বিরুদ্ধে যারা দাঁড়াচ্ছে, যাদেরকে বলা হচ্ছে লেফট-হেগেলিয়ন, বামপন্থী, তারা আবার হেগেলের এই অংশটাকে নিন্দা বর্জন করছেতুমি যে তত্ত্ব দাঁড় করিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল জার্মান স্বৈরতন্ত্রী রাষ্ট্রের প্রশংসা করছ, আমরা এটার তীব্র বিরোধিতা করিকিন্তু তুমি যে মেথডটা নিয়ে এলে দর্শনে, তর্কবিতর্ক করা, একটা জিনিসকে আরও পাঁচটা জিনিসের সঙ্গে যুক্ত করে বোঝা, পরিবর্তনকেই বিশ্বের সাধারণ প্রবণতা হিসাবে চিহ্নিত করা, এই প্রিন্সিপ্‌লগুলো খুব কার্যকরআমরা তোমার বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির এদিকটা নিচ্ছি

মার্ক্স তখন লেফট হেগেলিয়ান, এঙ্গেলসও তাইমার্ক্স জানতেন না, কিন্তু এঙ্গেলস বিভিন্ন জার্মান ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে দর্শনের ক্লাস করে এসেছেন মাঝে মাঝেসেখানে নিয়ম ছিল যে, যে কেউ গিয়ে ক্লাস করতে পারেডিগ্রি পাবে না, পরীক্ষা দিতে পারবে না; কিন্তু যে কোনো অধ্যাপকের ক্লাস তুমি গিয়ে শুনে আসতে পারতখন মার্ক্স এঙ্গেলস কেউ কাউকে চিনতেন না, দুজনেই হয়তো একই ক্লাসে বসে থেকেছেনকিন্তু পরিচয় হয়নিএই লেফট-হেগেলিয়ান প্রভাব নিয়ে চলতে চলতে ১৮৪১ সালে ফয়ারবাখের একটা বইটা প্রকাশিত হয়, The Essence of Christianity (খ্রিস্ট ধর্মতত্ত্বের সারকথা)এই বইটা সেদিন ছিল ভাববাদের বিরুদ্ধে বস্তুবাদের তরফে একটা প্রবল আঘাতযে জার্মানিতে এর আগে প্রায় একশ দেড়শ বছর ধরে ভাববাদের প্রবল প্রভাব চলে আসছিল, কান্ট ফিকটে শেলিং হেগেল হয়ে, সেই পরিবেশে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ফয়ারবাখের বইটা এলএল অনেকটা যেন পরিষ্কার ঝকঝকে আকাশ থেকে প্রচণ্ড বজ্রপাতের মতএঙ্গেলস বলছেন, বইটার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এরকম: এতদিন পর্যন্ত জার্মান দর্শন চর্চা ছিল অধ্যাপক বুদ্ধিজীবীদের ভাষার ঘোরতর মারপ্যাঁচকোনো কিছুই দার্শনিক এবং ভাষ্যকাররা খুব সহজ করে বলতে পারতেন নাকান্টের ভাষাই বলুন, আর হেগেলের ভাষাই ধরুন, তা ছিল অত্যন্ত জটিল একাডেমিক স্টাইল, সহজে বোঝা যায় না, সহজে তার অর্থ উদ্ধার করা যায় নাফয়ারবাখ এসে প্রথম একেবারে সাধারণ মানুষের মেঠো ভাষায় দর্শন শাস্ত্রকে দাঁড় করিয়ে দিলেনআমজনতা যে ভাষায় কথা বলে সে ভাষায় লিখতে শুরু করলেনফলে তারও একটা প্রভাব পড়ল সমকালীন চিন্তাবিদদের উপরদর্শনের এতদিনকার ভাবনা চিন্তা যেভাবে চলছিল মানুষকে যেভাবে প্রভাবিত করছিল সেটা বদল হলযেমন, ধরা যাক কান্টকান্ট হচ্ছেন আধা বস্তুবাদী আধা ভাববাদীকীভাবে আমরা চিন্তা করি, জ্ঞানলাভ করি—এসব প্রশ্ন নিয়ে যখন তিনি আলাপ শুরু করছেন, তার প্রাথমিক ঢংটা হচ্ছে বস্তুবাদীআমাদের চেতনার বাইরে স্বাধীন ভাবে বস্তু আছে, বস্তু জগত বাস্তবে থাকে, আছেতার থেকে আমাদের জ্ঞানের শুরুআবার যখন তিনি—আমরা শেষ পর্যন্ত জানি কী করে—বোঝাতে যাচ্ছেন, তখন বলছেন ওই বস্তুকে আমরা জানতে পারি নাএবং সেটা এত জটিল ভাষায় বলা যে কী বলেছেন আসলে সেটা বোঝা খুব কঠিনখুব ভালো করে বারবার না পড়লে সহজে বোঝা যায় নাএকই ভাবে, হেগেল যে কী বলছেন, কোন প্রসঙ্গে কী বলেন খুব ভালো করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে না পড়লে সহজে বোঝা যায় না

এই ব্যাপারে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় জটিল ভাষা ব্যবহারের একটা চমকপ্রদ উদাহরণ দিয়েছেনআমাদের দেশে প্রাচীন কালে দেখা যেত­—একদল যারা সংস্কৃত লিখত, কঠিন কঠিন শব্দ কঠিন কঠিন প্রকাশভঙ্গি এসব ব্যবহার করতমীমাংসা দর্শনের প্রবর্তক কুমারিল ভট্ট একবার বিদ্রূপ করে বলেছিলেন: যেটা আসলে লালা সেটাকে যদি বক্ত্রাসব বল, তাহলে কি লোকে বুঝবে? বক্ত্রাসব একটি সংস্কৃত শব্দ, আবার লালা শব্দটাও সংস্কৃতে আছেতাহলে লালা না বলে বক্ত্রাসব বলবে কেন? বললে তো খুব বেশি লোক বুঝতে পারবে নাতাহলে পণ্ডিতরা এই শব্দগুলো ব্যবহার করে সাধারণ মানুষকে খানিকটা ঘাবড়ে দেওয়ার জন্য[চট্টোপাধ্যায় ] তবে এর পাশাপাশি কেউ যদি আবার শঙ্করাচার্যের লেখা পড়ে, তাহলে একজন বাঙালির মনে হবে বাংলা পড়ছি, হিন্দিভাষীর মনে হবে সে হিন্দি পড়ছে, এরকম আর কি, মানে অনেক সহজ করে লেখাফয়ারবাখও এরকম, তাঁর রচনাবলি হচ্ছে জলের মতন সহজফয়ারবাখের দার্শনিক মতবাদ যে খুব গভীর সেরকম নয়, কিন্তু তাঁর বৈশিষ্ট্য হল যে তিনি জার্মানিতে প্রথম ভাববাদকে প্রবলভাবে আক্রমণ করে তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিলেনসরল এবং স্পষ্ট ভাষায় বললেন, চিন্তা আগে নয়, বস্তু আগে, বস্তু থেকে চিন্তাএরকম প্রাঞ্জল ভাষার একটা প্রভাব আছে, এই প্রভাবের ফলে ফয়ারবাখের চিন্তার দ্বারা মার্ক্স-এঙ্গেলস দুজনেই প্রবল ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেনএবং ১৮৪১ থেকে ১৮৪৪ সাল পর্যন্ত তাঁদের উপর ফয়ারবাখের প্রভাব বজায় ছিলদেখা গেল, শুধু এই দুই বন্ধুই নন, জার্মানিতে যারা লেফট হেগেলিয়ান ছিলেন তারা রাতারাতি ফয়ারবাখিয়ান হয়ে গেলেনএবং, আমি আবারও বলছি, মার্ক্স এবং এঙ্গেলস দুজনেই যে ফয়ারবাখিয়ান হয়ে গেলেন, একজন জার্মানিতে বসে ফয়ারবাখের শিষ্য, আর একজন ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে বসে, দুজনের কেউ কিন্তু একে অপরের সেই খবরটা তখন পর্যন্ত জানতেন না

১৮৪১ থেকে ১৮৪৪ সাল পর্যন্ত মার্ক্সের উপর ফয়ারবাখের প্রভাব কেমন ছিল একটু দেখে নিইবহু বিষয়ে আলোচনার জন্য, ধারণা পাওয়ার জন্য মার্ক্স ফয়ারবাখকে চিঠি লিখতেনএমনকি, অন্যদের মার্ক্স চিঠি লিখতেন যে যদি এই সব বিষয়ে বুঝতে চাও তাহলে ফয়ারবাখ পড় “ফয়ারবাখ” (Feuerbach) জার্মান শব্দটার আক্ষরিক ইংরেজি মানে হল স্পিরিট অফ ফায়ারমার্ক্স এই স্পিরিট অব ফায়ারকে কোট করে বলতেন, তোমরা এনার থেকে নাওতিনি যখন ওই প্রবন্ধটা লিখছেন—"Critique of Hegel’s Philosophy of Right"—তখন তাতে ফয়ারবাখের ব্যাপক প্রভাব রয়েছেযেটাকে লোকে মার্ক্সের ক্রিটিক অফ রিলিজিয়ন বলে মনে করে, সেটা আসলে মার্ক্সের ফয়ারবাখিয়ান ক্রিটিক অফ রিলিজিয়নমার্ক্স তখনও মার্ক্সবাদী নন, তিনি ফয়ারবাখের লাইন ধরে রিলিজিয়নের সমালোচনা করছেনপার্থক্য শুধু এইটুকু যে ফয়ারবাখের তুলনায় মার্ক্স সমাজ অর্থনীতিটাকে আরও বেশি করে ধরতে চাইছেনফয়ারবাখের আলোচনায় সমাজ অর্থনীতি ইতিহাস এগুলো খুব একটা জায়গা পায়নিএর বাইরে বাকি যে যুক্তির ধারা, যে বক্তব্য, এমনকি মার্ক্সের যে বক্তব্য “opium of the people”, এই বাক্যের হুবহু একই রকম শব্দবন্ধ ফয়ারবাখের মন্তব্যেও রয়েছেযেখানে উনি বলছেন, রিলিজিয়ন হচ্ছে “sleeping pill of the people”, অর্থাৎ, একই রকম কথনএই প্রভাব নিয়ে মার্ক্স তখন এগোচ্ছেন

কিন্তু দুঃখের কথা হল এই যে প্রায় দুনিয়ায় কোন মার্ক্সবাদী এই কথাটা মনে রাখতে পারেন নাএটা আগেকার প্রজন্ম পারেননি, তার একটা মানে আছে, তখন হাতে এত তথ্য ছিলনাকিন্তু এখন এই সব তথ্য রচনা খুবই সহজলভ্যঅন্তর্জালের কল্যানে কোনটা কবেকার লেখা, কোন context-এ লেখা, এখন তা চাইলে সবাই জানতে পারেতখন তারা দেখবে যে এই বক্তব্যটা মার্ক্সের মার্ক্সবাদী বক্তব্য নয়মার্ক্স, এঙ্গেলস তখনও সেই জায়গায় পৌঁছাননি, তার আগেকার বক্তব্য, তার কতগুলি লক্ষণ এই লেখার মধ্যে আছেযেমন, একটা বড় লক্ষণ হচ্ছে, এখানে রাষ্ট্র নিয়ে কোনো কথাই নেইএখানে ধর্ম নিয়ে যে লেখাটি আছে সেখানে state and civil society এইভাবে সমাজকে দেখা আছেএই state and civil society, এটা হচ্ছে একটা Hegelian paradigm, মানে একদিকে state বা রাষ্ট্র আর অন্যদিকে জনগণ বা civil society, এটা এক অর্থে বলা যায় যে বুর্জোয়াদের সমাজ বিশ্লেষণমার্ক্সিস্টরা তো তা করে না, মার্ক্সিস্টরা রাষ্ট্রকে একটা শ্রেণির হাতিয়ার হিসাবে দেখেসমাজটাকে দেখে শ্রেণি বিভক্ত সমাজ হিসাবে, ফলে যেটা civil society সেটা একটা uniform society নয়তার মধ্যে আবার শ্রমিক আছে, চাষী আছে, মধ্যবিত্ত আছে, নানা ধরনের পাতি বুর্জোয়া আছেসেগুলো কিন্তু এই লেখার মধ্যে নেইসেগুলো মার্ক্সের পরের লেখায় থাকবে, ফলে বোঝা যায় মার্ক্স তখনও সমাজের শ্রেণি বিশ্লেষণে যাননিশুধুমাত্র এই Hegelian term-এ এরকম বলছেন, এরকম আরও কিছু বিষয় আছেএমনকি আজকাল মার্ক্সের যে কথাটা খুবই ব্যবহৃত হচ্ছে যে ধর্ম হচ্ছে নিপীড়িতের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন পৃথিবীর হৃদয় এরকম করে একটা বয়ান আছেযে বয়ানটা খুব ব্যবহার হচ্ছেচার দিকে সবাই এটা দেখিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে মার্ক্স ধর্ম বিরোধী ছিলেন নাঅথচ এই প্রত্যেকটা কথাই হচ্ছে আসলে এই ফয়ারবাখিয়ান প্রেক্ষিত থেকে বলাফয়ারবাখের বক্তব্যটা ছিল যে ধর্ম কোনো একটা সময় থেকে বিকৃত হয়ে সমাজে প্রচুর কুসংস্কার চাপিয়ে দিয়েছে, কিন্তু আসলে ধর্ম মানুষে মানুষে প্রেম প্রীতির জারকরসে ঐক্য স্থাপন করে, তারই প্রভাবে মার্ক্স এই কথাগুলো বলেছেনসেই অর্থে এটা মার্ক্সের মার্ক্সবাদী বক্তব্য নয়পরবর্তী কালে মার্ক্স যখন পুঁজি গ্রন্থে কিছু কিছু আলোচনা করেছেন আর এঙ্গেলস বিভিন্ন জায়গায় আলোচনা করে দেখিয়েছেন, সেখান থেকে বোঝা যায় তাঁরা ধর্মকে ছদ্ম-চেতনা (false consciousness) বলেছেনআমরা চেতনার ভিত্তিতে বোঝার বদলে যখন আমরা মিথ্যা চেতনায় বুঝবার চেষ্টা করি, তখন আমরা ধর্মে গিয়ে পৌঁছাইআর যাকে আমরা ভগবান বলছি সেটা হচ্ছে শ্রেণিবিভক্ত সমাজে মানুষেরই উলটানো প্রতিবিম্ব (inverted image of the man that’s due to the class society)এইগুলো মার্ক্স এঙ্গেলসরা অনেক পরে ব্যাখ্যা করে বলেছেনফলে শ্রেণিবিশ্লেষণ যতক্ষণ না আসছে এই ব্যাখ্যাগুলি মার্ক্সবাদী ব্যাখ্যা নয়সমস্ত মার্ক্সবাদী লেখক বা মার্ক্সবাদী পার্টি—শুধু ভারতে এরকম নয়, সারা দুনিয়া জুড়ে—সে সব কথা ভুলে গিয়ে এটাকে ধর্ম সম্পর্কে মার্ক্সবাদী ব্যাখ্যা বলে ধরে নিয়েছেআবার যাঁরা ধর্ম প্রসঙ্গে মার্ক্সের বক্তব্যকে সমালোচনা করেন, তাঁরাও এটাকে মার্ক্সের মার্ক্সবাদী বক্তব্য ধরে নিয়েই সমালোচনা করেনএখানে এই বয়ানে কী কী ভুল আছে তা দেখার কোনো মানে নেইএর মধ্যে অনেক ভুল কথা পাওয়া যাবে, তার কারণ, এটা তখনও পর্যন্ত মার্ক্সের মার্ক্সিস্ট বক্তব্যই নয়এইটা হচ্ছে সমস্যাযাই হোক ফয়ারবাখের এইরকম একটা প্রবল প্রভাবের ফলে হেগেলের প্রভাবটা সাময়িক ভাবে মার্ক্স এঙ্গেলসের চিন্তা ভাবনায় খানিকটা পিছু হটে যায় এবং তারা অনেকটা ফয়ারবাখিয়ান প্রভাব নিয়ে এবারে সামাজিক অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের মধ্যে ঢোকেন

আবার ওদিকে এঙ্গেলস সমাজ অর্থনীতি শ্রেণি সংগ্রাম শ্রমিকদের অবস্থা এইদিক থেকে বুঝতে বুঝতে ক্যাপিটালিজমকে চিনতে চিনতে এগোচ্ছেনতিনি নিজে পুঁজিপতি বাবার ছেলে, ফলে পুঁজিবাদকে খুব কাছ থেকে দেখেছেনআবার শ্রমিক বস্তিতে ঘুরে ঘুরে চিনতে পারছেনএই দিক থেকে তিনি এগোচ্ছেনএবং তার ভিত্তিতে পড়াশোনা স্টাডি লেখা ইত্যাদিফলে ১৮৪৪ সালে যখন দুজনে মিট করছেন, তখন দুটো চিন্তা জ্ঞানের প্রবাহ, যাদের মূল অভিমুখটা একই দিকে, এক জায়গায় এসে দুটো নদীর মতো মিলে গেলমার্ক্সের থেকে এঙ্গেলস পেলেন দর্শনআর এঙ্গেলসের থেকে মার্ক্স পেয়ে গেলেন সেকালের সবচাইতে অগ্রসর ধনতান্ত্রিক দেশের শ্রমিক শ্রেণির বাস্তব পরিস্থিতি সংক্রান্ত ধারণাতারপর থেকে তাঁদের বক্তব্য আরও পরিষ্কার, আরও তীক্ষ্ণ হয়ে গেলএই সময়েই মার্ক্সের রচনা Economic and Philosophical Manuscripts 1844এই বইয়ের লেখাগুলিও মার্ক্স এঙ্গেল্‌সের জীবদ্দশায় অগ্রন্থিত এবং অপ্রকাশিত ছিলএমনকি এঙ্গেল্‌স এই পাণ্ডুলিপি কখনও হাতে পেয়েছিলেন বা পড়েছিলেন কিনা—আমার সন্দেহ আছেএখন সেটা পড়লে দেখা যাবে, এখানে তখনও রাষ্ট্র কোথাও নেইএখানে সিভিল সোসাইটি আছেএখানে কোথাও কোথাও শ্রমজীবী মানুষ, শ্রমিকদের অবস্থা, তাদের কথা আছেকিন্তু সেটা শ্রেণি হিসেবে প্রায় নেইএই লেখাগুলিতে কোথাও কোথাও তিনি কমিউনিজমের কথা বলছেনকারণ, ইউরোপে তখন কমিউনিজম কথাটা এসে গেছেসোশ্যালিজম কমিউনিজম এসব কথাকে ধরে তখন ব্যাপকভাবে চর্চা হচ্ছেতর্ক বিতর্ক চলছেকিন্তু মার্ক্সের লেখায় সেই কমিউনিজমেরও আর্থসামাজিক বুনিয়াদ কী হবে তা নিয়ে কোনো কথা নেইশুধু বার বার ব্যক্তিসম্পত্তি বিলোপের কথা উঠে এসেছেযদিও এই রচনার নামে আছে ইকোনমিক ম্যানুস্ক্রিপ্ট, সেখানে অর্থনৈতিক শোষণের কিছু কথা আছে, কিন্তু অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ নেই সেরকমএটা আসছে এঙ্গেলস থেকেআবার এঙ্গেলসের লেখায় তখনও পর্যন্ত গভীর দার্শনিক বিবেচনার তেমন কোনো ছাপ নেইOutlines of a Critique of Political Economy, Condition of the Working Class in England, ইত্যাদি রচনার মধ্যে কোথাও দর্শনের কথা নেইএঙ্গেলস সেটা মার্ক্সের কাছ থেকে নিচ্ছেনএইভাবে তাহলে দেখা যাচ্ছে যে দুটো currents of thought সেদিন এক জায়গায় এসে ইন্টিগ্রেটেড হল, সব কিছু মিলে একটা পূর্ণাঙ্গ তাত্ত্বিক সত্তা যেন জন্ম নিচ্ছে

১৮৪৩-৪৫ সালগুলিতে মার্ক্স এঙ্গেল্‌সের এই শিক্ষার্থী মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যাবে তাঁদের সমসাময়িক কিছু রচনায়১৮৪৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মার্ক্স আরনল্ড রুগে-কে এক পত্রে লিখছেন: “Hitherto philosophers have had the solution of all riddles lying in their writing-desks, and the stupid, exoteric world had only to open its mouth for the roast pigeons of absolute knowledge to fly into it. Now philosophy has become mundane, and the most striking proof of this is that philosophical consciousness itself has been drawn into the torment of the struggle, not only externally but also internally. But if constructing the future and settling everything for all times are not our affair, it is all the more clear what we have to accomplish at present: I am referring to ruthless criticism of all that exists, ruthless both in the sense of not being afraid of the results it arrives at and in the sense of being just as little afraid of conflict with the powers that be.” [Marx 1843]

প্রায় একই সময়ে টমাস কার্লাইলের একটি প্রবন্ধের বই সমালোচনা করতে বসে এঙ্গেল্‌স লিখেছিলেন: “All social philosophy, as long as it still propounds a few principles as its final conclusion, as long as it continues to administer Morrison’s pills, remains very imperfect; it is not the bare conclusions of which we are in such need, but rather study, the conclusions are nothing without the reasoning that has led up to them; this we have known since Hegel; and the conclusions are worse than useless if they are final in themselves, if they are not turned into premises for further deductions. But the conclusions must also assume a distinct form for a time, they must in the course of development evolve from vague imprecision into clear ideas. ...” [Engels 2010, 457; emphasis added]

মরিসনের বড়ি ছিল উনিশ শতকের ইংল্যান্ডে একটা খুব জনপ্রিয় ভেষজ ওষুধ, যাকে লোকে মনে করত সমস্ত রোগের দাওয়াইজেমস মরিসন ছিলেন একজন হাতুড়ে ডাক্তার, যিনি নিজে বানিয়ে এগুলো বেচতেনআমাদের দেশের এখনকার পাতঞ্জলির ট্যাবলেটের মতোএঙ্গেল্‌স এখানে সেই বড়ির উল্লেখ করেই দেখাচ্ছেন, আমাদের সর্বরোগহর দাওয়াই না খুঁজে কোন অসুখের কী দাওয়াই খুঁজতে হবে

খুব অবাক হয়ে আরও একবার দেখতে পাই, উপলক্ষ যাই হোক, ইউরোপের দুই প্রান্তে বসে দুই যুবক সেদিন একই লাইনে ভাবছিলেন

দুখানা বই: দুরকম ইতিহাস

এই প্রেক্ষাপটেই দুই বন্ধু ঠিক করলেন, দর্শন এবং অর্থনীতি সম্পর্কে যতটা জ্ঞান তাঁরা আয়ত্ত করতে পেরেছেন একটা যৌথ রচনা প্রকাশ করে তা জনগণের কাছে তুলে ধরবেনভাববাদী দর্শন এবং সমাজ ভাবনা—দুটোর বিরুদ্ধেই একটা বস্তুবাদী প্রকল্প পেশ করতে হবে১৮৪৪ সালের শরৎ কালে লেখা হল সেই বই, “পবিত্র পরিবার বা বৈচারিক সমালোচকদের সমালোচনা” (The Holy Family, or Critique of Critical Criticism)শিরোনামেই মালুম, এটি ছিল দুই যুবকের বেশ একটা জমাটি শ্লেষাত্মক রচনা!

সেই সময় জার্মানিতে মোটামুটি ১৮২০-এর পর থেকে ১৮৫০ পর্যন্ত অনেকগুলো বই বের হয়যে বইগুলো হচ্ছে ধর্মীয় বিষয়ে সমালোচনাএই জার্মানি তখন এগোনোর রাস্তা খুঁজছে, জার্মানিতে রেনেসাঁস এসেছে অনেক পরেমার্টিন লুথার যিনি শুরু করেন এক সময়, তাঁর আন্দোলনটা খ্রিস্ট ধর্মের পুরনো যে আকারটা ছিল তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহএই মার্টিন লুথার কিন্তু অনেক পুরনো, মানে ষোড়শ শতকেরতারপরে এই প্রোটেস্টান্ট মুভমেন্ট হওয়া সত্ত্বেও জার্মান জাতি অনেক দিন পর্যন্ত সাহিত্য জ্ঞান বিজ্ঞানের জগতে খুব বেশি এগোতে পারেনিআঠারো শতকের শেষ ভাগে এসে জার্মানি বিজ্ঞানের দিকে কতগুলো মেজর জায়গায় ব্রেকথ্রু ঘটালোএখানে গণিতে গাউস বলে একজন ছিলেনতঁকে বলা হত গণিতের রাজপুত্রসেই গাউস একজন এথিস্টকিন্তু কোথাও নিজের বক্তব্য প্রকাশ্যে বলতেন নাবিপদ হতে পারে এই ভয়েএমনকি আঠারো শতকে জার্মানিতে লোকে এসব ভালো করে বলতে পারতেন নাতার পরে একটু একটু করে ঘোর কাটতে লাগলইতিহাস এবং বাইবেল থেকে কেউ যিশু খ্রিস্টের জীবন উদ্ধার করার চেষ্টা করলেনকেউ দেখাচ্ছেন, বাস্তবে যিশু খ্রিস্ট বলে কেউ কোনো কালে ছিল নাএটা হচ্ছে পিটার পল প্রমুখ খ্রিস্ট ধর্মের প্রচারকদের নির্মাণ, তারা মিলে বিভিন্ন রূপকথাকে একত্রিত করে একজন ধর্ম প্রবর্তকের একটা জীবন কাহিনি দাঁড় করিয়েছেপিটারের সঙ্গে পলের বক্তব্যে কোথায় কোথায় বিরোধ আছে, এই সবও তাঁদের কেউ দেখাচ্ছেনআবার কেউ কেউ (যেমন ব্রুনো বয়ার এবং এডগার বয়ার দুই ভাই মিলে) যুক্তি তর্কের সাহায্যে ধর্মের পক্ষে একটা সমর্থন দাঁড় করানোরও চেষ্টা করছিলেনএমনকি ফয়ারবাখের যে প্রথম বইটা সেটাও হচ্ছে ধর্মীয় সমালোচনাউনিশ শতকে প্রথম একটা তর্কবিতর্ক আলোচনার মধ্য দিয়ে এগুলো শুরু হলবিভিন্ন ইউনিভার্সিটিগুলো সেন্টার হয়ে গেল এই সবেরধর্মের সমালোচনার মধ্য দিয়ে চিন্তাগুলো এগোলএই সমস্ত ঘটনাকে সামনে রেখেই মার্ক্স এবং এঙ্গেল্‌স তাঁদের প্রথম বইটি ১৮৪৫ সালের গোড়ায় প্রকাশ করলেনএখানে তাঁদের দার্শনিক এবং ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের দৃষ্টিভঙ্গির একটা সূচনা লক্ষ করা যায়এখানেই তাঁরা ঘোষণা করলেন যে “Ideas can never lead beyond an old world order but only beyond the ideas of the old world order. Ideas cannot carry out anything at all. In order to carry out ideas men are needed who can exert practical force.” [Marx and Engels 1980, 148] শুধু যুক্তি তর্ক আর মতবাদ নয়, তাকে কার্যকর করার মতো লোকবল চাইযারা সমাজকে কেন পাল্টাতে হবে জানে এবং বোঝে

কিন্তু দুজনেই তাঁরা অনুভব করলেন, এখানে যতটা অন্যদের সমালোচনা করা হল, সেই অনুপাতে নিজেদের অবস্থান ইতিবাচক ভঙ্গিতে খুব স্পষ্ট করে রাখা হয়নিঅতএব এই নতুন চিন্তাধারাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই তাঁরা এর পরে হাত দিলেন জার্মান ইডিওলজি রচনায়ভাববাদের সমালোচনা তাতেও থাকবে, কিন্তু নিজেদের নবলব্ধ ধারণাগুলি আরও বিশদে তুলে ধরতে হবে

ঠিক হল, এই রচনাটাও দুজনে তাঁরা এক সাথে লিখবেনকিন্তু এবারের এক সাথে মানে খুব ইন্টারেস্টিংএকই পাতার মাঝখান দিয়ে একটা ভাগ আছেএকটা কলামে মার্ক্স লিখে যাচ্ছেন, পাশে আর একটা কলামে এঙ্গেলসএকই পাতাতেএকই সাবজেক্টে দুজনে যাঁর যা মনে হচ্ছে তাঁরা লিখে যাচ্ছেন১৮৪৬ সালে মার্ক্স ব্রাসেলস-এ থাকার সময় লেখা শেষ হয়পরে যখন বই আকারে বেরিয়েছে তখন এগুলো মিলিয়ে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছেবইটা আসলে বেরিয়েছে এঙ্গেলসও মারা যাবার (১৮৯৫) অনেক পরেসোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে দভিদ রায়াজানভের সম্পাদনায় ১৯৩২ সালে মার্ক্স এঙ্গেল্‌স ইন্সটিটিউট থেকেযাঁরা বের করেছেন তাঁরাই লেখাগুলোকে বিষয় অনুযায়ী মিলিয়ে মিশিয়ে দিয়েছেন [Marx and Engels 1976: এই বইতে ৫৫ পৃষ্ঠায় মূল পাণ্ডুলিপির এক পাতার একটা ছবি আছে, পাঠকরা দেখে নিতে পারেন] এখন আর কোন অংশটা মার্ক্সের লেখা, কোন অংশটা এঙ্গেলসের লেখা তা আলাদা করে বোঝা যাবে না, যাঁরা মোটামুটি দুজনকার ভাষার সাথে পরিচিত তাঁরা পড়লে খানিকটা বুঝতে পারবেনদুজনে মিলে একই মতবাদিক চিন্তাকে আকার দান করা বলতে যা বোঝায় অনেকটা সেই রকমজার্মান ইডিওলজি এক রকমের একটা যৌথ স্টাডির ফসলএবং পরবর্তীকালে মার্ক্সবাদের যে মূল দার্শনিক বক্তব্য, এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদ, তার অনেক কিছুই ওতে একটু অপরিণত আকারে পাওয়া যাবেএবং লেনিনের বক্তব্য হচ্ছে যে এই বই লেখার কাল থেকেই মার্ক্স-এঙ্গেলসের মার্ক্সবাদী হওয়ার যাত্রা পথের শুরুতার আগে পর্যন্ত, তাঁরা হচ্ছেন প্রি-মার্ক্সিস্ট, প্রিলিউড টু মার্ক্সবাদদর্শন চিন্তায় এগোচ্ছেন; কিন্তু দুজনের একজনও তখন অবধি পুরোপুরি মার্ক্সবাদী হয়ে উঠতে পারেননি১৮৪৫-৪৬ সালের ওই পাণ্ডুলিপি রচনার পর থেকে তাঁরা পুরোপুরি মার্ক্সিস্ট হচ্ছেন

দুঃখের বিষয়, এই পাণ্ডুলিপির জন্য মার্ক্স এঙ্গেল্‌সরা কোনো প্রকাশক খুঁজে পাননিহয়ত সেই সময় জার্মানির প্রকাশকরা এতটা গরম একখানা ম্যানুস্ক্রিপ্ট–এর প্রকাশক হওয়ার ঝুঁকি নিতে চায়নিকাগজপত্রগুলি কোথায় পড়েছিল, মার্ক্স এঙ্গেল্‌স তাঁদের ঘোরাঘুরির জীবনে অনেক দিন কোনো খবর রাখেননিফলে তাঁদের জীবদ্দশায় এটাকে আর ছাপানোর ব্যবস্থা করে ওঠা সম্ভব হয়নি

এই বইটার নাম কেন “জার্মান ইডিওলজি” হল, তার কারণটাও একটু বোঝার দরকার

সেখানে তাঁরা শুরুতেই দেখালেন, “The entire body of German philosophical criticism from Strauss to Stirner is confined to criticism of religious conceptions. . . . It has not occurred to any one of these philosophers to inquire into the connection of German philosophy with German reality, the relation of their criticism to their own material surroundings.” [Marx and Engels 1976, 35-36] এইভাবে দুই বন্ধু চিন্তার সঙ্গে বস্তুর সম্পর্ক, চিন্তাধারার সঙ্গে বাস্তব সামাজিক পরিস্থিতির সম্পর্ক—ইত্যাদি বিষয়গুলি নিয়ে পর্যালোচনায় হাত লাগালেনআমরা দেখতে পাব যে এর পর এতে শ্রমিক শ্রেণি, রাষ্ট্র, সিভিল সোসাইটি, উৎপাদন সম্পর্ক, উৎপাদিকা শক্তি, ইত্যাদি—ঐতিহাসিক বস্তুবাদের বিভিন্ন সমস্যার উপরে একটা বিশ্লেষণাত্মক আলোচনা দর্শনের আধারে এগোচ্ছেমূলত সমকালীন জার্মান বুদ্ধিজীবীদের লেখাপত্রের সমালোচনার সূত্র ধরেই তাঁরা তাঁদের বক্তব্যকে পেশ করেছেন বলেই ওরকম নাম দিয়েছেন বলে মনে হয়

লক্ষণীয় হচ্ছে, এই বইতে তাঁরা প্রথম কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের জায়গায় পৌঁছলেনতার মধ্যে প্রথম কথাটা হচ্ছে, যেটা ইতিহাসের বস্তুবাদী ব্যাখ্যা হিসাবে আমরা বলি, মানুষের সমাজ বিকাশের যে ইতিহাস তার মূল খুঁজতে হবে মানুষের চিন্তাধারার মধ্যে নয়, বাস্তব উৎপাদন পদ্ধতির মধ্যেমানুষের বেঁচে থাকার জন্য সমাজে উৎপাদনের যে প্রক্রিয়া, বস্তুগত উৎপাদন, তার মধ্যে যে পরিবর্তন হয় তার থেকেই সমাজ ব্যবস্থা বদলায় এবং সেই অনুযায়ী মানুষের চিন্তাধারাও বদলায়এগুলো একটা তত্ত্বগত আকারে ওখানে লেখা আছেএবং লেখার ধরনটা বেশ সুন্দরমানে অনেক বিষয় আছে যেটা এখনও আমরা ব্যবহার করি

দুনম্বর হচ্ছে, ওখানে ওঁরা দেখানোর চেষ্টা করছেন যে আমরা যেগুলোকে মানুষের আইডিয়া, চিন্তাভাবনা বলি, সে চিন্তা ভাবনাগুলো আসলে হচ্ছে এক একটি শ্রেণির চিন্তাএবং ওখানে একটা বিখ্যাত কথা আছে যে “The ideas of the ruling class are in every epoch the ruling ideas; i.e., the class which is the ruling material force of society is at the same time its ruling intellectual force.” [Ibid, 67; italics in the original] এই ভাবধারার মধ্যে শাসক শ্রেণির কথাটা উত্থাপনের মানে কী ? এর মানে হল, বেশিরভাগ মানুষ যে চিন্তা ভাবনাগুলো বহন করে, সে ভাবছে তার নিজেরই চিন্তা, কিন্তু আসলে সে না জেনে এবং অনিচ্ছাকৃত ভাবে বহন করছে শাসক শ্রেণির চিন্তাএই কথাটাকে ওখানে নানাভাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হয়েছে

তৃতীয়ত, সেই বইতে দেখানো হয়েছে, মানুষের চেতনার দ্বারা তার জীবনযাপন প্রক্রিয়া নির্ধারিত হয় না, বরং তার জীবনযাপনের প্রক্রিয়াই তার চেতনা নির্ধারণ করে দেয়যেটা আমরা মার্ক্সবাদীরা অনেক সময় উদ্ধৃতি আকারে লিখে থাকিএর প্রেক্ষাপটটা হচ্ছে, অনেকেরই ধারণা ছিল তখনও পর্যন্ত, বা এখনও ভাববাদীদের মধ্যে এটা আছে, চিন্তা চেতনা ভাবনার জগত, এগুলো হচ্ছে স্বতঃস্ফূর্তআপনা আপনি জন্মায়এগুলোর বস্তুগত বা সামাজিক কোনো ভিত্তি নেইমার্ক্স এঙ্গেল্‌স দেখালেন, না, সোশ্যাল কন্ডিশনটা, social existence-টাই তোমার মধ্যে বিশেষ ধরনের চিন্তাভাবনার জন্ম দেয়তুমি কী চিন্তা ভাবনা কর এটা দিয়ে তোমার social existence নির্ধারিত হয় না; social existence-ই তোমার চিন্তা ধারাকে নির্ধারণ করেএরকম কতগুলো, পরবর্তীকালে মার্ক্সবাদের খুব গুরুত্বপূর্ণ থিসিস, আমরা জার্মান ইডিওলজি বইটাতে খুব পরিষ্কার দেখতে পাই

তারপর তাঁদের সমাধান করতে হয়েছে যে ভাববাদ এবং বস্তুবাদের মধ্যে তাঁরা কোন দিকে থাকবেন। এই যে বস্তুবাদ, যাকে বলা হচ্ছে ডায়ালেকটিকাল মেটেরিয়ালিজম, এই বস্তুবাদকে তখন এখানে বেছে নিতে হয়েছেজার্মান ইডিওলজির মধ্যে এটা প্রকটভাবে আছেআবার, এই বস্তুবাদের চরিত্র কী রকম? এই বস্তুবাদ কি আগেকার বস্তুবাদের মতো? আগেকার যে বস্তুবাদ, অর্থাৎ, ইংল্যান্ডে সপ্তদশ শতকে যে বস্তুবাদের ব্যাপক চর্চা হয়েছে, ফ্র্যান্সিস বেকন, টমাস হবস, জন লক, রিচার্ড ওভার্টন, জন টোল্যান্ড—এরকম আরও যাঁরা বস্তুবাদী ছিলেন, বস্তুবাদের পক্ষে অনেক কথা বলেছেন, তাঁদের মতো? পরের শতাব্দে ফরাসি বিপ্লবের আগে ফ্রান্সেও বস্তুবাদের একটা ব্যাপক, আরও শক্তিশালী চর্চা হয়েছে: জাঁ জ্যাক্স রুশো, ফ্রাঁসোয়া মারি আরুয়েত (ভোলতেয়ার), পিয়র বেইল, দনিস দিদেরো, ক্লদ হেলভেতিয়াস, অঁরি হলবাক, মার্কুইস দ্য কঁদ্রসে, এরকম অনেকগুলো নাম আছেযাঁরা একের পর এক এসেছেন এবং নানান ভাবে বস্তুবাদের পক্ষে ঝড় তুলেছেনএঁরা যে বস্তুবাদকে ডিফেন্ড করেছেন আর মার্ক্স এঙ্গেলস যে বস্তুবাদকে নিয়ে চলতে চাইছেন, এই দুটো কি এক? এখানে যে পার্থক্য, সেটাকেও তাঁরা আলাদা করে দেখানোর চেষ্টা করেছেনফয়ারবাখ, যিনি দুই শতাব্দ প্রাচীন ইং-ফরাসি বস্তুবাদের শেষ প্রতিনিধি এবং সর্বোচ্চ পরিণতি, তাঁর চিন্তার সীমাবদ্ধতা উন্মোচনের মধ্য দিয়েই তাঁরা নতুন বস্তুবাদের স্বাতন্ত্র্য পরিস্ফূট করতে চেয়েছেন

এই প্রসঙ্গেই এসে পড়ছে মার্ক্সের থিসিস অন ফয়ারবাখসবাই জানেন, এই নামে মার্ক্সের কতগুলো সংক্ষিপ্ত লেখা আছেএগারোটা থিসিসতাতে মার্ক্স দেখাচ্ছেন, পুরনো বস্তুবাদের  সমস্যা হলো যে সে চেতনার গুরুত্বকে ধরতে পারছে নাএমন কি কোনো কোনো বস্তুবাদী দার্শনিক, যেমন কার্ল ফোগট বলে একজন, সম্ভবত জার্মান বস্তুবাদী, বলতেন—লিভার থেকে যেমন আমাদের পিত্তরস ক্ষরিত হয় তেমনি মস্তিষ্ক থেকে চিন্তার ক্ষরণ হয়এইভাবে তুলনা করছেনএবং এটাই তখনকার বস্তুবাদ যেখানে চিন্তা চেতনার আলাদা করে কোনো ভূমিকা নেইএটা একটা মস্তিষ্কের সরাসরি প্রোডাকশনএকে বলা হয় যান্ত্রিক বস্তুবাদফয়ারবাখ এর থেকে এগোতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বেশি দূর যেতে পারেননিমার্ক্স তাই থিসিস অন ফয়ারবাখে বলছেন, জার্মান ইডিওলজিতেও আছে, বিষয়টা এরকম  নয়চিন্তা চেতনা একটা অ্যাক্টিভ ঘটনাঅর্থাৎ যে মানুষ চিন্তা করে, সে মানুষ কিন্তু ক্রিয়াশীলতার চিন্তার পেছনে থাকে ব্যক্তিসত্তার একটা সক্রিয় ভূমিকাএই জায়গাটাকে মার্ক্স ধরাবার চেষ্টা করছেনথিসিসের এক নম্বরেই তিনি বলছেন, এতদিন পর্যন্ত বস্তুবাদীরা এই চেতনার সক্রিয় দিকটাকে অগ্রাহ্য করেছেনসমাজ পরিবর্তন কোনো একরেখ ব্যাপার নয়এর মানে হল, বিদ্যমান সামাজিক পরিস্থিতি এবং মানুষের জায়মান চেতনার মধ্যেকার নিরন্তর দ্বান্দ্বিক ঘাতপ্রতিঘাতের অনিবার্য ফসলফলে চেতনার ক্রিয়াশীলতা নিয়ে ভাববাদীরা চর্চা করেছেআমাদের এখন ভাববাদীদের কাছ থেকে এটা কেড়ে নিতে হবেনিয়ে আমাদের এটাকে বিকশিত করতে হবেচেতনার প্রশ্নে তাহলে তাঁরা পুরনো বস্তুবাদের থেকে একটা বিচ্ছেদ ঘটাচ্ছেন

আর দু'নম্বর বিচ্ছেদ হচ্ছে ডায়ালেকটিক্সএই যে বস্তু থেকে চিন্তা বা এই যে সমাজ বিকাশের প্রশ্নগুলো, শুধুমাত্র পরিবর্তনশীল বলে তাঁরা ক্ষান্ত ননকী নিয়মে পরিবর্তন হবে? সমাজ বিপ্লব হয় কেন? ইংল্যান্ডে ফ্রান্সে বুর্জোয়া বিপ্লব হল কেন? দুটি ঐতিহাসিক বিপ্লবের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি কী কী? এটাকেও ধরার চেষ্টা করছেন দার্শনিক দিক থেকেএবং এটাকে ধরতে পেরে ধীরে ধীরে তাঁরা, যেটাকে আমরা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বলি সেদিকে এগোচ্ছেনএই জার্নিটা মোটামুটি বলা যেতে পারে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো-তে গিয়ে একটা পরিণতি পেয়ে যায়যখন তাঁরা দ্বন্দ্বমূলক ঐতিহাসিক বস্তুবাদের জায়গাতে পৌঁছে গেছেনমার্ক্সবাদের জন্মের আদর্শগত ইতিবৃত্তটা হচ্ছে অনেকটা এইরকম

এর পর এর আবির্ভাব সময়ের আর্থসামাজিক ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতও আমাদের বুঝে নিতে হবে

 

 

গ্রন্থসূত্র:

Frederick Engels (2010), “The Condition of England. Past and Present by Carlyle (an extended book review)”;Marx-Engels Collected Works, Vol. 3; Lawrence and Wishart, London (Electric Book).

Karl Marx (1843), Letter to Arnold Ruge, September 1843; Marxist Internet Archive.

Karl Marx and Frederick Engels (1976), The German Ideology; Progress Publishers, Moscow.

Karl Marx and Frederick Engels (1980), The Holy Family or Critique of Critical Criticism; Progress Publishers, Moscow.

G.V. Plekhanov (1976), “Translator’s Preface to the Second Russian Translation of Engels’ Ludwig Feuerbach and the End of German Classical Philosophy”; Selected Philosophical Works, Vol. III; Progress Publishers, Moscow.

J.V.Stalin (1949),Dialectical and Historical Materialism; Foreign Languages Publishing House, Moscow.             ক্রমশঃ            

লেখক পরিচিতি

Ashoke Mukhopadhyay
Ashoke Mukhopadhyay
Free-lance science writer and activist; General Secretary of CESTUSS and The Other Mind.
0 Comments
Leave a reply