বিবেকানন্দ--কিছু কথা ..পর্ব ১

By : Ashoke Mukhopadhyay | : 02 February, 2022
বিবেকানন্দ--কিছু কথা  ..পর্ব ১

প্রসঙ্গ স্বামী বিবেকানন্দ: আরও দুচার কথা

১২ জানুয়ারি সূর্য সেন এবং স্বামী বিবেকানন্দকে যুক্ত করে নিয়ে ফেসবুকে একটা পোস্ট করেছিলাম। এমনিতে এই দুই ব্যক্তিত্বের মধ্যে তুলনা বা সংযোগের প্রশ্ন আসে না। ঘটনাচক্রে এই একটি দিনে একজনের জন্মদিন এবং অপর জনের আত্মদান দিবস মিলে গেছে। ১৯৩৪ সালের পর থেকে ক্যালেন্ডারের এই পাকচক্রকে আমাদের আর এড়িয়ে যাওয়ার কার্যত কোনো উপায় নেই। তবে একটা ব্যাপার আছে। যাঁরা বিবেকানন্দকে নিয়ে মেতে থাকতে চান, তাঁরা সূর্য সেনকে ভুলে থাকতে পারেন। থাকেনও। যাঁরা সূর্য সেনকে স্মরণ করেন (সংখ্যায় খুব কম), তাঁরা হয়ত আর একই পোস্টে বিবেকানন্দকে টেনে আনেন না।

আমার অবস্থান আলাদা। আমি শুধু যে এই দুই ব্যক্তিত্বকে একই দিনে স্মরণ করতে চাই তাই নয়, তুলনা করতেও ভালোবাসি।

                                                                                                       

রে রে রে রে .....

---------------

অনেকের তীব্র গোঁসা হবে জানা থাকা সত্ত্বেও আমার পক্ষে এই তুলনা না করে উপায় থাকে না। ভারতের সমাজ বিকাশে এবং স্বাধীনতা প্রাপ্তির পেছনে এঁদের ভূমিকার তুলায়ন না করলে আমার কেবলই মনে হয়, আমরা অতীতের ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেবার কাজে ফাঁকি দিচ্ছি।

তুলনাটা দীনেশ গুপ্ত বা আসফাক্উল্লাহকে নিয়েও করা যেত। এখনও করা যায়। ক্ষুদিরাম বা ভগত সিং-কে নিয়েও করা যায়। আবার অন্য দিকে বিবেকানন্দের বদলে অরবিন্দ ঘোষকে নিয়েও এরকম তুলনা করা সম্ভব। তাহলে, বিশেষ করে সূর্য সেন এবং বিবেকানন্দকেই বেছে নিলাম কেন?

এরকম একটা প্রশ্ন আমার সেই পোস্টে অনেকেই করেছেন।

তাঁরা আসলে বুঝতেই পারেননি, এই তুলনাকাণ্ডে বিবেকানন্দ এবং সূর্য সেনের এসে পড়াটা স্রেফ আকস্মিক—গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডারের কারণে। বাংলা ক্যালেন্ডার ধরলেই দিনগুলি বছর বছর আলাদা হয়ে যেত। দুঃখের বিষয়, রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে বাংলা ক্যালেন্ডার ধরে থাকলেও বিবেকানন্দের বেলায় ইংরিজি ক্যালেন্ডারই মান্য। এটা দস্তুর। অতএব এতে আমার কোনো হাত নেই।

 

                                                                                                     

হ্যাঁ, এটা ঠিক, সূর্য সেন সম্পর্কে আমি যা লিখেছি, তা অন্য একজন যে কোনো শহিদ বিপ্লবীকে নিয়েও লেখা যেত। বয়ানে উনিশ বিশের বেশি তফাত হত না। পাশাপাশি, বিবেকানন্দের পরিবর্তে অরবিন্দকে নিলে স্ববিরোধিতার অভিযোগটি তুলে নিতে হত। কিন্তু ভারতীয় সমাজের মনন ও সংস্কৃতির বিকাশে অবদানের প্রশ্নে তেমন একটা তারতম্য হত না।এ নিতান্তই ইংরিজি মাধ্যম কালের রাখালের খামখেয়াল যে ১২ জানুয়ারি এই দুজন বিশেষ মানুষের প্রসঙ্গ আমাকে এক সঙ্গে  লিখতে হচ্ছে।

যে কোনো বছরের ১২ জানুয়ারি, আমার পুত্র অনর্ঘর কথায়, “ফেসবুক যেন বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠ” হয়ে ওঠে। ছবিতে উদ্ধৃতিতে পোস্টের পর পোস্টে ছয়লাপ। সেই তুলনায় সূর্য সেনের উপরে পোস্ট খুব কম। মাস্টারদার ছাত্র নেই বললেই চলে। অনুপাত অনেকটা এরকম: ১৪৭ বাই ১। সেই ফাঁকা জায়গাটা ভরাট করার জন্যই কয়েক বছর ধরে আমি এরকম একটা পোস্ট আজকাল করছি।

আমার এই একটা পোস্ট এবার ভয়ঙ্কর রকমের সাফল্য পেয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে প্রচারের নিরিখে। অর্থাৎ, ফেসবুকে আমার বন্ধুদের এক বিরাট সংখ্যা এই বক্তব্যকে পছন্দ করেছেন, নানা ভাবে উৎসাহ ব্যঞ্জক মন্তব্য করে আমার উদেশ্য সফল করে তুলেছেন এবং শেয়ার করে আরও অনেকের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, যাঁরা অন্যথায় আমার অধরা থেকে যেতেন।

সাফল্যের অন্য দিকটা হল বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠের মৌচাকে ঢিল পড়া। সেই ব্যাপারেই আজকের বর্ণবিন্যাস।

স্বামী বিবেকানন্দ প্রসঙ্গে আমরা সমাজ সচেতন যুক্তিবাদী বিশ্লেষকরা যে বিষয়গুলিকে প্রকাশ্যে টেনে আনতে চাই, তাতে ওঁদের ভীষণ আপত্তি। একে তো এঁদের বিবেকানন্দ পাঠ দত্তজার ৩২ খানা উদ্ধৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ। উদ্বোধন কার্যালয় থেকে প্রকাশিত দশ খণ্ডের বাণী ও রচনা পড়ে ওঠার সময়ও এঁদের নেই, ইচ্ছা বা আগ্রহও একেবারেই নেই। ব্যাতিক্রম নেই এমন হয়ত নয়, তবে সে গুনে ফেলতে এক হাতের আঙুলই যথেষ্ট।

বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠের এই ভক্ত ছাত্রদের পাঠ দৈন্য সবচাইতে বেশি রকম প্রকট হয়ে ওঠে প্রায় সকলেরই একটা সাধারণ (একই সঙ্গে অসাধারণ) ভুল মন্তব্যে: মার্ক্সবাদী দলের প্রবক্তারা নাকি বিবেকানন্দকে অপছন্দ করে এবং বিরুদ্ধে বলে।কথাটা অসত্য শুধু নয়, বিতিকিচ্ছিরি রকমের অট্টহাস্যকর।

আমার জানায় অধিকাংশ কমিউনিস্ট দলগুলি ধর্মের প্রশ্নে এখন নয়, বহুকাল ধরেই মুখে প্রায় কুলুপ লাগিয়ে বসে আছে। ব্রাহ্মণ্যবাদ, বেদবেদান্ত, আদি শাস্ত্রের জাতিবিদ্বেষ, ইত্যাদি নিয়ে তারা কোনো সমালোচনামূলক মন্তব্য করতেই চায় না। আর বিগত কয়েক দশক ধরে তারা অসম্ভব নরেন দত্তের ভক্ত হয়ে উঠেছে। তাদেরও দত্ত জ্ঞান ভাণ্ডার সীমা উল্লিখিত বত্রিশটা বাণী। সেই সব ব্যবহার করে তারাও বুঝিয়ে থাকে, নরেন দত্ত একদিন ভারতে কী সাংঘাতিক একটা কাণ্ড নাকি করে ফেলেছিলেন।

পড়াশুনার অভ্যাস না থাকায় বিদ্যাপীঠের ভক্তরা এই খবরটাও না জেনেই মার্ক্সবাদী দেখলে বা শুনলেই তেত্রিশ নম্বর একটা বাণী আওড়ে ফেলতে শুরু করে দেন: “হে ভারত, ভুলিও না, কমিউনিস্ট বামপন্থীরা আমাকে পছন্দ করিতেছেন না!”

ধারণাটা সর্বৈব ভুল। আমাদের দেশের কমিউনিস্টদের ৯৫ শতাংশই দত্ত ভক্ত। দত্ত একদিন রামমোহন বিদ্যাসাগরের রেনেশাঁস প্রয়াসের বিরুদ্ধে যা করেছিলেন, আজকের নরেন ভক্ত মার্ক্সবাদীরাও কমিউনিস্ট আন্দোলনের অগ্রগতির রাস্তা সাফ করার প্রশ্নে একই কাজ করে চলেছেন। অবশ্য না জেনে।

সেই জন্য বিবেকানন্দের সামাজিক ঐতিহাসিক ভূমিকা আমাদের আরও ভালো করে বুঝে নেবার প্রয়োজন আছে। আবেগ দিয়ে নয়, তথ্যের আলোকে।

তথ্যের আলোকে বিচার করলে স্বামী বিবেকানন্দের জীবন কর্ম থেকে আমাদের যুক্তিবাদী মার্ক্সবাদীদেরও নেবার মতো হিরের দুচারটে খনি আছে। আমার পুরনো লেখায় আমি তা সশ্রদ্ধায় উল্লেখ করেছি। এখানে তার সবিস্তার পুনরুক্তি করে রাখতে চাই। কেন না, সেই জায়গাগুলো আবার ভক্তিবাদী ও ভক্ত মার্ক্সবাদীদের চোখে পড়ে বলে দেখা যায় না।

এক, বিবেকানন্দ তাঁর গুরু রামকৃষ্ণের মতোই একজন উঁচু দরের সংগঠক। রামকৃষ্ণের সংগঠন শক্তির পরিচয় মেলে সমকালীন বেশ কিছু নামী বুদ্ধিজীবীকে দক্ষিণের ঈশ্বর (আসলে কালী) দর্শনে টেনে আনার মধ্যে। নরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর সেরা রিক্রুট। নরেন্দ্রনাথ দত্ত এমন একজন চরিত্র যিনি যেখানেই যাবেন, সেখানেই নেতা হয়ে উঠবেন। পেছন পেছন চলার পাত্র তিনি নন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রাহ্মসমাজে গিয়ে গানের দলেও তিনিই চালক গায়ক। রামকৃষ্ণ শিষ্যদের মধ্যেও তিনিই সর্দারপোড়ো। প্রথম দিকে অনেক গাঁইগুঁই করলেও সমবয়সী শিষ্যরা সকলেই শেষ অবধি নরেনকে তাঁদের দলনায়ক বলে মেনে নেন। গুরু আর অন্য সতীর্থদের মতো তাঁর নজর শুধু মন্দিরের ভজনসঙ্গী বৃদ্ধি নয়। হিন্দু ধর্মকে মঠ পীঠ মন্দিরের বাইরে টেনে নিয়ে যাওয়া, বৌদ্ধ ধর্ম, খ্রিস্টধর্ম বা ইসলামের মতো একেও একটা সদস্য বৃদ্ধির সংগঠনে পরিণত করা, মিশন বানানো। তার জন্য কিছু আচার প্রথা বদলে দেওয়া। না বদলাতে পারলে কায়স্থ ঘরের সন্তান হয়ে তিনিই বা ধর্মাচার্য হবেন কী করে?

অর্থাৎ, ধর্মের জন্য সংগঠন বানাতে গিয়ে তিনি সংগঠনের স্বার্থে ধর্মেরও কিছু খোল কিছু নলচে বদলে দিলেন। স্বল্পায়ু জীবনের মধ্যেই তিনি দেশ নয়, প্রধানত বিদেশ থেকেই অর্থ সংগ্রহ করে বছর দশেকের মধ্যেই বেলুরে স্থায়ী মঠ নির্মাণের পাকা ব্যবস্থা করে ফেললেন। আর এক দল সার্বক্ষণিক সন্ন্যাসী তৈরি করে ফেললেন, যাদের খাওয়াদাওয়া মঠে থাকা এদিক ওদিক যাতায়াতের পয়সা আসবে মঠের সেই তহবিল থেকে।

তিনি যখন শিকাগো যাচ্ছেন তখন তাঁর বয়স মাত্র তিরিশ। শিকাগোয় তেমন চেনাজানা কেউ নেই। তথাপি সেখানে পৌঁছে তিনি কিছু সমর্থক বা শুভানুধ্যায়ী বানিয়ে ফেললেন খুব অল্প দিনের মধ্যেই। শিকাগোর ধর্ম সম্মেলনে তিনি যে দুটি ভাষণ দিয়েছিলেন, তার মধ্যে যুগান্তকারী কোনো বক্তব্য ছিল না। একজন হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসীর গড় বক্তব্যই তিনি উচ্চারণ করেছেন। যে কেউ আজও পড়ে দেখলেই তা বুঝতে পারবেন। সম্মেলনের প্রতিনিধিদের উপরে তাঁর কথার “প্রচণ্ড প্রভাব” হিসাবে প্রচারে যা সব বলা হয়ে থাকে, তার প্রায় সমস্তটাই তিনি গুরুভাইদের চিঠি লিখে বলে বলে এমনকি ধমকধামক দিয়ে নিজেই তৈরি করে দিয়ে গেছেন। বিবেকানন্দ ভক্তরা বিবেকানন্দের সেই বানিয়ে দেওয়া প্রচারকেই ঘটনার বিবরণ বলে মনে করেন।

প্রকৃত সত্য হচ্ছে, নরেন দত্তের তুলনায় অন্য দুজন ভারতীয় যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তাই বরং সম্মেলনে দাগ কেটেছিল তুলনামূলক ভাবে বেশি। কিন্তু তাঁরা আর কিছু করেননি। সংগঠন বানানো, সমর্থক তৈরি করা, অর্থ সংগ্রহ—এসব কিছুই আর তাঁরা করেননি। ফলে অচিরেই কাল বালুকায় তাঁদের ভাষণ স্মৃতি হারিয়ে গেছে। এমনকি স্বামীজিও তাঁদের সম্পর্কে রা কাড়েননি। আজ যদি তাঁদের নাম স্মরণ করা হয়, সে কেবল বিবেকানন্দের আলোচনা উপলক্ষেই।

তবে, স্বামীজি যে কাজে এবং যে পদ্ধতিতে সাংঠনিক দক্ষতা দেখিয়েছেন, সেই কাজে এবং সেই পদ্ধতিতে আমাদের—অন্তত আমার—আস্থা নেই। হিন্দু ধর্মের জয়গান, বেদান্তের প্রচারে আমাদের সেদিনও পেট বা মন ভরেনি, আজও ভরে না। বরং ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে যেমন সেদিন এই ধর্মীয় চিন্তা ও বিশ্বাস প্রতিবন্ধক ও গতি মন্দক হিসাবে ক্রিয়া করেছে, আজও সমাজ প্রগতির আন্দোলনে সেই একই ভূমিকা পালন করে চলেছে। তথাপি, গোটা পর্বে, জীবনের শেষ দশটা বছর তিনি যে সাংগঠনিক দক্ষতা দেখিয়েছেন, তা থেকে আমাদের শিখবার আছে। অন্য কাজে লাগাতে।  

দুই, ভারতের প্রাচীন ও মধ্য যুগের ইতিহাসের কিছু কিছু প্রশ্নে তিনি খুব বিস্ময়কর তথ্যানুগত্য ও যুক্তিশীলনের সাক্ষ্য রেখে গেছেন। দুঃখের কথা হল, তাঁর সতীর্থ বা শিষ্যদের আর কারও মধ্যেই সেই জ্ঞান বহ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়নি। ফলে তাঁর সেই ইতিহাস আনুগত্য ভক্তদের প্রায় কাউকেই আর উল্লেখ এবং চর্চা করতে দেখি না। এমনকি নরেন ভক্ত মার্ক্সবাদীদেরও বোধ হয় এসব ব্যাপার নজরে পড়ে না। তাঁরা সকলেই তাঁর তথাকথিত ধর্মীয় উদারতার বাণী সকলে আপ্লুত হয়ে থাকেন এবং দশ মুখে উবাচেন {তথাকথিত কেন যোগ করলাম, পরে বিবেচ্য}!

উদাহরণ দিয়ে বলা যাক।

<> রামায়ণ মহাভারত প্রসঙ্গে আলোচনায় তিনি এই দুই মহাকাব্যকে ইতিহাস হিসাবে নয়, সর্বদাই পৌরাণিক রূপক কাহিনি হিসাবে গণ্য করেছেন এবং অন্যদেরও সেইভাবে দেখতে বলেছেন। ভারতীয় জনমানস সাপেক্ষে, বিশেষ করে তাঁর সময়ের সাপেক্ষে এটা যথেষ্ট অগ্রসর ও সাহসী ভাবনা। আহা, মিশন যদি এই ভাবনাকে প্রচার করে যেতে পারত, বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠের ছাত্ররা যদি এই ভাবনাকে গ্রহণ করতেন, আজ আমাদের রাম মন্দির বর্বরকাণ্ড হয়ত দেখতেই হত না।

<> বর্ণাশ্রম প্রসঙ্গে তিনি বেশ জোর দিয়ে বলেছেন, প্রাচীন ভারতে বা বৈদিক যুগে সন্ন্যাস আশ্রম বলে কিছু ছিল না। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দেখেই ব্রাহ্মণ্য ধর্মে সন্ন্যাস জীবনের ধারণা সঞ্চারিত হয়। তাঁর এক গুরুভাই মনুসংহিতার কথা তুললে তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, মন্বাদি সংহিতাগুলির বয়স কম, বৌদ্ধযুগের পরবর্তী রচনা। এই এক কথাতেই তিনি এক ঢিলে দুতিনটি আম পেড়ে ফেলেছেন। এক, প্রাচীন ভারতে চতুরাশ্রম প্রথা নামক বহু চর্চিত রূপকথাটির অস্তিত্ব এক ধাক্কায় নাকচ হয়ে যায়। দুই, আর এই যে বৈদিক “মুনি”-“ঋষি”দের আচরণ থেকেই হিন্দুদের যাবতীয় ধর্মীয় বোধভাস্যির জন্ম বলে একটা দীর্ঘকালীন প্রচার চলে আসছে, সেই ধারণাও ফেটে চৌচির হয়ে যায়। তিন, সেই সঙ্গে হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন শাস্ত্রকে যে ঠেলে ঠেলে হাজার হাজার বছরের পুরনো বলে চালানোর একটা চেষ্টা গরিষ্ঠাংশ ভারতীয় পণ্ডিতদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়, সেখানেও তিনি যেন কিছুটা ভিনেগার ঢেলে দেন।

<> “সবই বেদে আছে” জাতীয় মানস সন্তানকে খানিকটা ব্যঙ্গ করেই তিনিও বলেছেন, ভারতের হিন্দুদের মধ্যে এরকম একটা বিশ্বাস আছে যে “বেদে সব কিছু পাওয়া যায়, এমনকি গরু হারালেও বেদে খুঁজে পাওয়া যায়”। বোঝাই যায়, এই সব জিনিস তাঁর পছন্দের তালিকায় স্থান পায়নি।

<> গীতা নামক গ্রন্থটি, যাকে সঙ্ঘ লবি অনেক দিন ধরেই ভারতের জাতীয় পুস্তক হিসাবে ঘোষণা করার তদ্বির করে যাচ্ছে, বিবেকানন্দের সন্দেহ, শঙ্করাচার্য নিজে লিখে মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ পর্বে কৃষ্ণের বক্তৃতার আকারে ঢুকিয়ে দেন। অবশ্য তিনি লিখেছেন, “অনেকে মনে করেন”। কিন্তু তার পরে এর আর কাটান বাক্য কিছু দেননি। তাতেই আমাদের মনে হয়, তিনি তাঁর নিজের সন্দেহই অন্যের নাম করে শ্রোতাদের সামনে রেখে গেছেন। ভেবে দেখুন, এটা যদি বিবেকানন্দের বচন ক্রমে আমরা গ্রহণ করতে রাজি থাকি, এক ধাক্কায় কৃষ্ণের অস্তিত্বের প্রশ্নে বারোটা বেজে যায়, গীতার প্রাচীনত্ব এবং পাবিত্র্যের পারদ অনেকটা নীচে নেমে যায় এবং একই সঙ্গে শঙ্কর সম্পর্কে অনেকটা সন্দেহ দানা বেঁধে ওঠে।   

<> প্রসঙ্গ যখন এসেই গেল, তখন বলি, একাধিক জায়গায় তিনি শঙ্করাচার্যসহ অন্যান্য মান্যবরেষু শাস্ত্রকারদের “জাতপাতের দালাল”, “শকুনের মতো ভাগাড়ের দিকে নজর” ইত্যাদি বলে নিন্দা করেছেন। এরা অনেকে শাস্ত্র বচন জালিয়াতি করে শূদ্র নিন্দা করেছেন বলে তাঁর অভিযোগ। বুদ্ধ ও রামানুজের প্রশংসা করে তিনি বলেন, শঙ্করের মস্তিষ্ক খুব বড়, কিন্তু গরিবের দুঃখে কাঁদার মতো বড় হৃদয় তাঁর ছিল না। তাঁর জ্ঞান আসলে শুষ্ক পাণ্ডিত্য। এই সব মন্তব্য যে ভারতীয় অধ্যাত্মবাদীদের বক্ষে কতখানি আঘাত হানে, তা পরিমাপ করা দুষ্কর। নেহাত স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন বলেই তাঁর পাকিস্তানের ভিসা নিতে হয়নি। কিন্তু এ যদি আমরা যুক্তিবাদী মার্ক্সবাদীরা কেউ বলি, তাহলে যে কবেই ----

<> একই ভাবেই তিনি যখন বলেন, ইতিহাসে ধর্মাচার্যদের মধ্যে একমাত্র হজরত মহম্মদ ছাড়া বুদ্ধ, যিশু বা বিষ্ণুর অবতার হিসাবে পূজিত কৃষ্ণের অস্তিত্বের সপক্ষে কোনো ঐতিহাসিক সাক্ষ্য প্রমাণ নেই, তখন নিজের অজ্ঞাতেই তিনি হিন্দু হৃদয়ে এক কঠিন শক্তিশেল হেনে যান। এসব কথা হজম ও আত্মস্থ করতে যুক্তিবাদীদেরই যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়, ভক্তিবাদীদের যে কী হবে, বলাই বাহুল্য।

<> বৈদিক যুগ থেকে ব্রাহ্মণ সহ উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের গোমাংস ভোজন সম্পর্কেও তিনি ছিলেন সংস্কারমুক্ত এবং সোচ্চার। একাধিক বক্তৃতায় ও রচনায় ব্রাহ্মণদের গোমাংস খাওয়ার কথা তিনি তুলে ধরেছেন। কলকাতার গোরক্ষকদের তিনি ব্যঙ্গবিদ্রূপ সহ যেভাবে সমালোচনা করেছেন, আধ্যাত্মিক লাইনে তার উদাহরণ পাওয়া ভার।

<> স্বামীজির রচনাতেই আমি প্রথম জানতে পারি, এক কালে ব্রাহ্মণ্যবাদীরা বেশ কিছু (আসলে প্রায় সমস্তই) বৌদ্ধ মঠ ও বিহার দখল করে হিন্দু মন্দির বানিয়ে ফেলেছিল। যেমন, পুরীর বিখ্যাত জগন্নাথ মন্দিরও এক কালে বৌদ্ধ মঠ ছিল। এই সব তথ্য অন্য আধ্যাত্মিক গুরুরা পারতপক্ষে উচ্চারণই করেন না।

উপরে যা আলোচনা করা হল, সে সম্পর্কে দুটি টীকা দিয়ে রাখি:

(১) এই সমস্ত বিবৃতির বিরোধিতা করে তিনি অন্যত্র অন্য রকম কিছু বলেননি। অর্থাৎ, সচরাচর তাঁর বিরুদ্ধে যে স্ববিরোধিতার অভিযোগ ওঠে, এই সব প্রশ্নে তিনি তার থেকে মুক্ত।

(২) বিবেকানন্দ ভক্তরা আপ্রাণ চেষ্টা করে থাকেন, এই সব কথার যেন প্রচার না হয়। পাঠকরা খোঁজ নিলে এবং মিলিয়ে পড়লে দেখবেন, মিশন থেকে তাঁর যে ইংরিজি রচনাবলি বেরিয়েছে, তাতে এই সমস্ত অনাধ্যাত্মিক প্রসঙ্গ সযত্নে কাটছাঁট করে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে।  

    ছবিতে বরানগর মঠে গুরুভাইদের সঙ্গে (১৮৮৭)। সৌজন্যে : উইকিপিডিয়া

 

লেখক পরিচিতি

Ashoke Mukhopadhyay
Ashoke Mukhopadhyay
Free-lance science writer and activist; General Secretary of CESTUSS and The Other Mind.
5 Comments
  • avatar
    IydULKjSBxpKrD

    28 November, 2023

    VlFomWMaaSARTVJfzybJDuhqUJRB

  • avatar
    Ellianna

    14 December, 2023

    Rudy Tang

  • avatar
    Orlando

    26 December, 2023

    Ameer Grimes

  • avatar
    Jamison

    20 January, 2024

    Virginia Terry

  • avatar
    saydie

    26 March, 2024

    saydie willprecht

Leave a reply

Reclaiming the Dark

28 August, 2024 | : Ashoke Mukhopadhyay

Science vs Spiritualism

24 July, 2024 | : Ashoke Mukhopadhyay

Religious Fundamentalism

09 June, 2022 | : Ashoke Mukhopadhyay