বর্ষামাত্রিক

By : রেজওয়ান তানিম | : 15 November, 2021
বর্ষামাত্রিক

এক.

আমরা এখন আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছি পুরান ঢাকার দিকে। প্রায় পাঁচ শতক ধরে নানা ইতিহাস শহরের যে অংশ ধারণ করে আছে, আমাদের গল্পও যে এখানে এসেই লেগে থাকা জটটা খুলবে বোঝা যায়নিকে ভাবতে পেরেছিল তিন বছরেরও আগে ঘটে যাওয়া দক্ষিণবঙ্গের গহীন চরাঞ্চলের এক ঘটনার রেশ নিয়ে গল্পটা খোদ রাজধানী ঢাকায়, এই ব্যস্ত এলাকায় এসে ভিড়বে। নানান সাবধানতা মাথায় রেখে চললেও যেমন অনেক আশ্চর্য যেমন ঘটেই যায় তেমনি দেশের বিভিন্ন অন্ধকার, অন্ধ কানাগলি খোঁজাখুঁজি করে শেষে আসতেই হল ঢাকায়।

চানখারপুল এলাকা। খরতপ্ত মধ্যদুপুর। ঝাঁ ঝাঁ রোদ আগুন ঝরাচ্ছে, প্রখর তাপ সরাসরি আঘাত করছে নগ্ন মস্তকে পুরান ঢাকার ভাষায় চান্দিছিলা গরমের সময়টাতে রাস্তাজুড়ে চলছে স্থবির প্রায় জীবনের প্রদর্শনী। এ রাস্তা ইতিহাসের, একদিন এখানেই চলেছে মানুষে টানা রিকশা, ঢাকাই নবাবদের বাবুয়ানা ফিটন কিংবা তারও আগেকার প্রতাপশালী রাজাদের হস্তিযূথ; আর এখন চলছে টেম্পো, বাস, রিকশা, গাড়ি, সিএনজি, ট্যাক্সি ক্যাব, কালেভদ্রে দুচারটে আদ্যিকালের ঘোড়াগাড়ির দেখাও মেলে সব মিলে হযবরল দশা একদমমোড় থেকে হোসনি দালান বরাবর যে রাস্তাটা চলে গেছে সেই আগা সাদেক রোড ধরে এগোয় লোকটাবার দুতিন ডানবামে গলি বদল করে সুকু মিয়া লেনে আসার কিছুদূর বাদে দেখা মেলে নোংরা এক গলির, নর্দমার পানি উপচে ওঠা এই গলিমুখটা এত ছোট যে সিএনজি যেতেও কাঠখড় পোড়াতে হয়গলি পেরিয়ে আরও দুটো ছোট গলিতে ভুল করে চক্কর মারল সেঅবশেষে রাস্তার ডান দিকে গণেশের সেলুন আর রাজনের মুদি দোকান পার হয়ে সামনে মিলল সামান্য একটু বড় গলিটাগলির শুরুতে দুটো বহু পুরনো বাড়ি, কেউ কেউ বলে এগুলো নাকি ব্রিটিশ আমলে তৈরি। হতেও পারে আবার নাও পারে, জানা নেই সালতামামি তবে এটুকু নিশ্চিত বলা যায় এরা বহু পুরনো, কালের সাক্ষী ওদের ভগ্নদশা দর্শনার্থীদের আহত করে, খসে খসে পড়ে গেছে কতেক আস্তর, চুনকাম উঠে গেছে, এমনকি কার্নিশের দিকে গজিয়ে গেছে ছোট কিছু গাছ পুরনো পোড়বাড়ির মত বাড়ি দুটোর শেষটায় রয়েছে রজব আলী। লোকটাকে খুব দরকার মুসা মিয়ার। মুসা মিয়াকে আজকাল লোকে নুলা মুসা বলে জানে

দুপুর সময়ে রজব আলীর বাড়িতে থাকার কথা না। এটা তার জানা আর জেনেবুঝেই সময় ঠিক করে নেয়া, তবুও নিশ্চিত হতে দরজায় কড়া নাড়ল সেপ্রত্যাশা মাফিক মিলল না সাড়াবন্ধ দরজাকে কি করে সুবিধা মত খোলতাই করতে হয় ভালোই জানা আছে তারহাতসাফাইয়ের খেলের মত ম্যাজিক হল যেন, খট করে শব্দ শোনা গেল আর খুলল দরজাটা। গাঢ় কাপড়ের পর্দা টানা রয়েছে জানলায়, এত পুরু যে আলোর টিকির দেখাটিও মেলে না ছোট্ট দুকামরার ঘরটাতেঘরটা বেশ কিছুকাল ব্যবহার হচ্ছে না, কেমন গুমট আর বদ্ধ; ভ্যাপসা ভাব, বিছানাপত্র থেকেও আঁশটে গন্ধ বের হচ্ছে। ভেতর থেকে দরজা ভিজিয়ে লোকটা তালা বন্ধ করে দিল।

এরপর শুধুই অপেক্ষা।

দীর্ঘ অপেক্ষা।

রুদ্ধ নীরবতায়। চাপা অন্ধকারে।

অপেক্ষা কিছু রক্তের।  

অপেক্ষা আরেকটি খুনের।

আর এ অপেক্ষা মানুষের আদিমতম প্রবৃত্তির নাম।

হাবিলকে মারার জন্যে কাবিলের গুহায় লুকিয়ে থাকার মতই দীর্ঘ ও অসহ্য।

 

দুই.

ছলাৎ ছল।

খেলছে জলের তরঙ্গ চিন্তাহীন শৈশবের মত

হঠাৎ ভেসে আসে আরও কিছু জলকাটা ঢেউ। ভরা বর্ষায় জলের যোগানে নদীতে জেগেছে যৌবন, মাছেরাও পেয়েছে নতুন জলের স্বাদ। কী ভীষণ সুন্দর রূপো মাখা জল, সন্ধ্যা নেমে এসেছে বলে বোঝা যাচ্ছে না, দিনের আলো পড়লেই আশ্চর্য এক আভা নিয়ে জ্বলে উঠবে, চিকচিক করবে ওরা। জল কেটে কেটে কেমন একা একা বয়ে চলে মাছ ধরা ছোট্ট নৌকোটা। খর্বাকার নৌকায় ছাউনি নেই, থাকার কথাও নয় অবশ্য। গরীব জেলে আমিনুদ্দির এ নৌকো যাত্রী পারাপারের জন্য নয়, মাছ ধরাই তার জীবিকাছাউনি দেয়া বড় নৌকা হলে সুবিধা হত; বড় জাল বাইতে পারত, বেশী মাছের স্থান হত নৌকোতে দরকার হলে আরও দূরে, বিষকাঁটালি ছাড়িয়ে দরিয়ার কাছাকাছি চলে যেতচমকপ্রদ কত কি হতে পারত হয়তবা...

রাতে কড়কড়ে করে ইলিশ ভাজার সাথে দুটো মরিচ পোড়া আর একটু পেঁয়াজ দিয়ে জম্পেশ এক বেহেশতি খানা খেয়ে ঘুমের ঘোরে পরম সুখের খোয়াব দেখত আমিনুদ্দি; ওইখানে দারিদ্র্য নেই আর, ট্রলার মালিক বলে কথা; সাত চরের লোকেরা আসা যাওয়া করে ইঞ্জিনের সাম্পানেএসব শুধুই স্বপ্ন, অলীক বাস্তব এই ছোট নৌকাটা, বছর দুয়েক আগে কেনা।

নিজাম মোল্লার নৌকায় বর্গা দিয়েছে বহুকাল, দশটা বছর চেয়ে চেয়ে দেখেছে কেমন করে তাকে ঠকানো হচ্ছে মিথ্যের বেসাতি দিয়েবর্ষায় যখন মাছের বাড়ন্ত দশা, রোদ্দুরে ইলিশের আঁশে সোনা খেলে যায়, নিজাম মোল্লা তখন কপটতার আশ্রয় নেয় অশ্লীল মিথ্যাচার চলতে থাকে, ক্ষতির অভিনয়ে কামলাদের টাকা কম দেয়ার বায়না ধরে। নিজাম মোল্লার ঘরে দুপুরে যখন কালিজিরা চালের পোলাও, গরুর সিনার মাংসের ভুনা আর ইলিশ ভাজা হয় তখন আমিনুদ্দির মাথায় রক্ত চড়ে যায়, প্রবল ঘৃণা ছেয়ে ফেলে ওকেমনে হতে থাকে, ওই রান্না অপবিত্র; ওতে শরীর থেকে চুষে নেয়া রক্তের দাম লেগে আছেবোধহয় সত্যিই, হয়ত সে রান্নায় রক্ত ও ঘামের সাথে অনেক প্রতারণার গল্প মিলে মিশে একাকার। এ গল্পকে ভুলে যেতে চায় সে, তাই নিজের নৌকায় সে লিখছে দিন গুজরানের গল্প। কঠোর শ্রমকেও গায়ে না মেখে ফি বছর বর্ষায় পার ভাঙানো দেমাগি জলের কাছে জীবন বন্ধক দিয়ে মাছ ধরতে জলে নৌকা ভেজায়। জোয়ারের সময়ে শাখা নদী পানগুছি গিয়ে ভাটিতে যে বিষকাঁটালি নদীর সাথে মেশে সেখানে এপার আর ওপার যেন ভুলে যায় কূলের আলিঙ্গনদৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে দূরত্বে, দেখতে তখন কষ্ট হয়।

দিন দুয়েক আগে আলকাতরা লাগিয়েছে নৌকার খোলে, একটা উটকো গন্ধ আসছে তা থেকে। শহর থেকে আসা সাংবাদিক রাশেদ সাহেবকে সেই গন্ধ কিছুটা বিরক্ত করছেঅনেকটা সময় অভুক্ত রাশেদ উদ্দিনের মাথা কেমন ঝিমঝিম করছে আলকাতরার উৎকট গন্ধে। আমিনুদ্দিকে অনুনয় করেই জিজ্ঞেস করে সে

ও ভাই, ঘাঘরঘাঁটা আর কত দূর... ওইখানে রাতে কি কোন থাকার জায়গা আছে?

আমিনুদ্দি উত্তর করে আন্ধারে তো দেহিনা তেমন কিছু। তয় মনডা কইতে আছে আরও ঘণ্টা দুই লাগবে আনেসামনে তো কোন নৌকাও দ্যাখতে আছি না। রাইতে থাকনের ব্যবস্থা আছে কিনা এইডা তো মুই কইতে পারমু না।

যাত্রাপথের এই সমস্ত উৎকণ্ঠা কিংবা রাত্রিযাপনের সম্ভাবনা সবই বছর তিনেক আগের কথা। রাশেদউদ্দিনের এখানে আগমন অফিসের কাজে। বর্ষাটা ভাল যায়নি একেবারে, জেলায় জেলায় ভারী বন্যার শঙ্কা সত্যি হতে দেখা যায় আর দক্ষিণের এ অঞ্চল মোটামুটি নিয়মিতই প্লাবিত হয়। তুমুল বন্যায় বানভাসি লোকেদের অবস্থা, সেখানে ত্রাণ ঠিকঠাক পৌঁছল কিনা এ নিয়ে প্রতিবেদন তৈরিতেই রাশেদের ওখানে যাওয়াদুর্গম আর অপ্রতুল যাতায়াত ব্যবস্থার এলাকায় দেরিতে আসা উচিত না হলেও ঢাকা থেকে ফিরোজপুর আসতে প্রায় বিকেল হয়ে গেল। বেলা সাড়ে তিনটেয় জেলার চারপাড়া মোড় থেকে খাওয়া দাওয়া সেরে নেবার পর ঘাঘরঘাঁটা থেকে ট্রলারে উঠে নাজিরাবাদ ইউনিয়নে; বন্যার প্রকোপ সবচেয়ে বেশী যেখানে পৌঁছায়আগে থেকে যোগাযোগ করা আমিনুদ্দির নৌকায় করে বন্যার অবস্থা দেখতে যাওয়া এবং যে ধারণা নিয়ে সে এসেছিল অবস্থা তার চেয়ে অনেক খারাপ হওয়ায় চিন্তিত হল রাশেদস্কুলঘর আর মসজিদ এতদিন লোকে আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করেছে, এখন ও দুটোতে গেলে দেখা যায় কোমর সমান পানিসব দেখে শুনে, প্রয়োজনীয় ছবি ও তথ্যাদি নিয়ে ঘাটে ফিরতে দেরি হল বেশ, ফিরে এসেই বুঝতে পারল ঘটেছে বিপত্তি।

একটু আগেই ছেড়ে গেছে শেষ ট্রলারটা। সন্ধে তখন ঘোর।

আজ রাতে আর কোন ট্রলার নেই। কাল সকালে যেতে হবে। এমন অবস্থায় আমিনুদ্দিকে অনুরোধ করল যদি কষ্ট করে একটু ঘাঘরঘাঁটা পৌঁছে দেয়। আমিনুদ্দি রাজি হয়ে যায়, যদিও বৈঠা বাওয়া নৌকার জন্যে এখন বর্ষায় তো বটেই, শুকনোর সময়েও এ এক দীর্ঘযাত্রা বিশেষ করে যখন ভাটার টান লাগে বন্যার্ত লোকটার উপর উটকো ঝামেলা হিসেবে চেপে বসায় নিজের কাছেই খারাপ লাগে রাশেদ উদ্দিনের।

 

তিন.

ডেটলাইন ০৩ জুন, ২০১৭।

রাশেদউদ্দিনের জন্য আজ এক স্মরণীয় দিন। দৈনিক চোখের আলোতে তিন পর্বের ধারাবাহিক তদন্ত প্রতিবেদনের প্রথম অংশ বের হবার কথা। রাজধানীর তরুণ যুবকদের হাতে হাতে ইয়াবার যোগান। ফার্মেসিতে গিয়ে কনডম চাইলে যেমন সহজে মেলে তার চেয়েও সহজে মেলে ইয়াবা। কিনতে বাইরে যাবার দরকার পরে না, ফোন দিলে আশেপাশের দালালরাই ঘরের কাছে চলে আসে। নীচে গিয়ে নিয়ে এলেই হল। ইয়াবার ব্যাপক বিস্তার, নেশার সহজলভ্যতা, কারা এর মূল হোতা এসব নিয়ে গত দুমাস খাটাখাটি করে তৈরি হয়েছে লেখাটা। সকাল হতেই বেশ উত্তেজিত দেখা যাচ্ছে রাশেদকে

দরজার নীচ থেকে পেপার দিয়ে গেল কিনা বেশ কবার দেখে যায়, যদিও তখনো পত্রিকা আসেনি। বারান্দায় বসে অস্থির চিত্তে লোকেদের চলা ফেরা দেখতে থাকে রাশেদসকালের স্নিগ্ধতা আস্তে আস্তে মলিন হচ্ছে, ধুলো ও ধোঁয়া কথা বলে উঠছে; যাপনের বিবিধ লেনদেনে মেতে উঠছে এ পাড়া। বাড়ির সামনে শাকসবজির ভ্যানগাড়ি বেশ কয়েকটা আর একটিতে রয়েছে মুরগির ঝাঁকমুরগিওয়ালা কিছুক্ষণ পরপর হাঁক ছাড়ছে এই মুরগি মুরগ, মুরগিইইইই মুরগগগ...। তরতাজা সব সবুজ তরিতরকারি দেখে ছেলেবেলার কথা মনে আসে, মাঠ ভর্তি সবুজের মিছিল। এত রকম সবুজের মাঝ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে কাঁদা মাখা পা, চিত্রা নদীতে গামছা বেঁধে লাফিয়ে পড়া, স্মৃতি তাকে আবারো মনে করিয়ে দেয় বিশ বছর হয়েছে প্রায় গ্রাম ছেড়েছে তার পরিবার। গত পাঁচ বছরে একবারও যাওয়া হয়নি চিত্রার বুকে।

ভাইজান পেপার দিয়া গেছেকাজের বুয়ার ডাকে বুক যেন কেঁপে উঠল। প্রতিটি রিপোর্ট কিংবা সম্পাদকীয় নিবন্ধ ছাপা হলেই মনে হয় পরীক্ষা দিচ্ছে সে নিজের কাছে, প্রতিষ্ঠানের কাছে। লেখাটা কেমন হল, লোকে কি বলল, এ নিয়ে চিন্তা সবসময়। অনেকক্ষণ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল পুরো লেখাটা। এরপরে তুষ্ট মন নিয়েই পাতা উল্টাতে শেষ পাতায় ছোট্ট করে লেখা এক সংবাদে চোখ আটকালো। শিরোনামটা এমন ইউ পি চেয়ারম্যানের আত্মহত্যা: নাজিরাবাদে আতঙ্কনাজিরাবাদ নামটা চেনা চেনা মনে হয় কেমন। ঐ এলাকার কথা আগে কোথায় শুনেছে মনে করার চেষ্টা করতেই একটু পরে স্মরণে এল ঘাঘরঘাঁটা, ফিরোজপুর থেকে দুর্গম চরাঞ্চল নাজিরাবাদ ইউনিয়নে যাবার কথাসেখানে বন্যার্তদের নিয়ে রিপোর্ট করেছে দৈনিক মতান্তরে বছর তিনেক আগে। চেয়ারম্যান জয়নাল মাহতাব এলাকায় ছিল না তখন। তার লোকেরাই আমিনুদ্দিকে ঠিক করে রেখেছিল।

আচ্ছা, চেয়ারম্যান কি সত্যিই আত্মহত্যা করেছে? অন্ধরাতেও যে কখনো কখনো আশ্চর্য কিছু উপাখ্যান লেখা হয় তা জানে রাশেদ, এখনো সে রকম দুএকটা জ্বলজ্বল করছে স্মৃতিতে রহস্যের গন্ধ পেলেই শিকারি কুকুর হয়ে ওঠার পুরনো শখটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে রাশেদের খোঁজ লাগানো দরকার ভাবতেই দৈনিক চোখের আলো থেকে ফোন। সম্পাদক অভিনন্দন জানিয়ে বলল, রিপোর্টটা খুব দরকারি ছিলপুলিশ কমিশনার ফোন করে জানিয়েছে ব্যবস্থা নেবে তারাসাড়াশি অভিযান চলবে আগামী দিন দশেক। কিন্তু অভিনন্দন নিয়ে কথা দীর্ঘ না করে রাশেদ প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করল

আচ্ছা নাজিরাবাদের ইউপি চেয়ারম্যানের আত্মহত্যার রিপোর্টটা কে করেছে বলতে পারেন? 

-ওই যে মোশতাক জহির। কেন বলুন তো?

না, মানে... আসলে ওর সাথে কথা বলা গেলে একটু ভাল হত।

-আচ্ছা। বলবেন। কি বিষয়?

আসলে, বছর কয়েক আগে নাজিরাবাদে বন্যার উপরে রিপোর্ট করতে গেছিলাম ওই জায়গাটার কথা শুনে তাই স্বাভাবিক কৌতূহল হল...

আরও মিনিট পাঁচেক কথা হল সম্পাদকের সাথে। কথায় কথায় রাশেদের মনে সুঁই হয়ে বিঁধতে থাকা সন্দেহের কথা জানায় তাকে। যদিও বন্যার সেই রিপোর্ট করতে গিয়ে চেয়ারম্যানের সাথে যোগাযোগ হয়নি তখন, তাই বলা মুশকিল লোকটা কেমন; কিন্তু তবুও ব্যাপারটা কেমন গোলমেলে, যে লোকের সংসারে নতুন বউ আছে, দুটো মেয়ে তার আত্মহত্যা, তাও নিজের গলা কেটে; কেমন অদ্ভুত রহস্যে ঘেরা পুরো ব্যাপারটা। বিশ্বাস করা একটা বালকের জন্যেও কঠিন। সম্পাদক অফিসে মোশতাক ফিরলেই তাকে রাশেদের সাথে যোগাযোগ করতে বলে দেবেন জানিয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করল। সমস্ত ঘটনাটা ভাবার জন্যে হাতে বেশ কিছু সময় আছে। এখনো পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আসেনি পুলিশের কাছ থেকে, তাই জোর দিয়ে বলা যায় না যে এটা খুন, যা প্রচার হয়ে আছে সেটাই আপাতত সত্য এটা একটা আত্মহত্যাই। অস্থির পায়চারি করা রাশেদ ফোনের অপেক্ষায় থাকে আর অস্বস্তিতে স্বস্তি দেয় এই ভাবনা দিন দুয়েকের মাঝেই জানা যাবে, এটা আত্মহত্যা নাকি খুন। যদিও শতকরা নয়জন বিষয়টাকে সাধারণ বলে উড়িয়ে দিত, রোজকার জীবনের তরঙ্গহীন সংবাদে পরিণত হত অন্যদের বেলায় কিন্তু রাশেদের জন্য তা নয়, আর তাই তার ভ্রু কুঁচকেই থাকে, সোজা হয় না এই সুন্দর সকালে...  

 

চার.

মেঘ গুড়গুড় শোনা যাচ্ছে প্রবল আড়ম্বরে, কী প্রচণ্ড হুংকার তার বজ্রনির্ঘোষে। সমস্ত আকাশ এখন কালিময় আঁধারে ঢেকে রেখেছে নিজস্ব নগ্নতারাত্রি দশটা। ঘুটঘুটে অন্ধকার। বিকেলে পেঁজাতুলা মেঘগুলো দেখে মনে হচ্ছিল বিশাল ক্যানভাসে আঁকা ভ্যানঘগের তৈলচিত্র ঝুলে আছে আকাশের শেষে, দেখতে না পেলেও রাশেদ উদ্দিন ধারণা করতে পারে ওগুলো জীবনের শেষ পর্যায়ে এখনপ্রভূত শ্রম দিয়ে একটু একটু করে পোয়াতি নারীর মত বাড়িয়ে তোলা ওদের পেটের পরে জমে থাকা বাড়ন্ত জল আর উগ্র বিদ্যুৎ ছড়িয়ে যাবে সর্বত্র। যারা বহু দূর থেকে ভেসে ভেসে এসেছিল এই রুপো জল পানগুছির ঠিক উপরে, ওরা খুব ভাল জায়গা বেছে নিয়েছে নিজেদের শেষ হবার উৎসবটুকু বৈচিত্র্যপূর্ণ করার জন্যে।

মেঘগুলোর শেষ প্রতিরোধটুকু ভেঙে পড়ল কিছুক্ষণের মাঝেই। হঠাৎ ঠাণ্ডা হয়ে আসা চারপাশে বড় বড় ফোঁটায় ঝরতে শুরু করল বৃষ্টিধারা। বৃষ্টির সময়টাতে নদীর বুকে প্রবল উথালিয়া নৃত্য যে কারো বুকে কাঁপন ধরাতে যথেষ্ট। এই অসময়ে নদীতে থাকা কোন দুঃসাহস নয় বরং বোকামি। এই বোকাটে দশায় আবিষ্কার করা গেল একটা ছোট ডিঙ্গি নৌকায় সাংবাদিক রাশেদ আর তার মাঝি আমিনুদ্দিকে। দুজনেই জবুথুবু হয়ে এক ছাতির নীচে আশ্রয় নিয়েছে। ছাতিটি তত বড় নয় যাতে বৃষ্টিজলের ছোঁয়াচ থেকে দুজনেই বাঁচতে পারবে, তবু যা হচ্ছে তাও ঢের; গায়ে বৃষ্টিছাঁট গড়িয়ে পড়লেও মাথা বেঁচে যাচ্ছে এও কম নয়। তাদের নৌকো অবশ্য ভেজানো আছে বড়সড় একটা বালু বোঝাই জাহাজের এক পাশে। ওটার জন্য বৃষ্টির একেবারে ভিজিয়ে দেয়া মুষলধারাটা ওদের গায়ে কমই লাগছে। জাহাজটা হঠাৎ চরায় আটকে গেছে। ছাড়তে জোয়ার আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। জাহাজের লোকেরা ভাটার সময় বলে ছেড়ে গেছে এটাকে, নিস্তব্ধ জাহাজে তাই কোন রা নেই, শুধু আছে নদীর আছড়ে পড়ার শব্দ জাহাজের সারেং বা অন্যান্যরা আশ্রয় নিয়েছে চরের গেরস্থ বাড়িতে। রাশেদ সাহেব আমিনুদ্দির কাছে এরকম ভয়ংকর বৃষ্টিতে মাছ ধরার কথা শুনে চোখ কপালে তুলে বলল

এই অবস্থায় আপনি মাছ ধরেন? কেমনে পারেন ভাই!

আপনে কি পাগল নাকি। হোলি শিট! আপনার নৌকায় তো চালা নাই। আপনের ঠাণ্ডা লাগে না। এইরকম বিচ্ছিরি বৃষ্টিতে দুইদিন ভিজলে তো ঠাণ্ডা লাগবে

-আগে তো মোর নৌকায় চালা ছেলে। এই নৌকাতো বেশিদিন অয় নাই, মোল্লা বাড়ির নৌকায় কামলা দেতাম। হন্ধা বেলার আজান দেওনের পর থেইকা হারা রাইত মাছ মাইররা বেইন্যা কালে ফেরতাম।

সারারাইত মাছ ধরতেন? কন কি ভাই আপনে, সবসময়?

-হ। মাইঝ রাইতে নাও বিয়াইলে মাছ মারা পরে বেশী। হের লাইগা মোল্লা সাবে রাইতেই যাইবার কইতেন। আচুক্কা বৃষ্টি নামলে চালার তলে বইতাম। তয় ঝপঝপাইয়া পড়তে থাকলে কিচ্ছু হরার থাকতে না, জাল তো বাইতে হইবে।

কিন্তু এখন তো আর ওনার হয়ে কাজ করছেন না, এখনো কি রাতে মাছ ধরেন ?

-অহন রাইতে আর মাছ মারি না। চোহেও ভাল দেহিনা এখন আর। গেরামের লোকেরা মোরে দেখলেই জম্মের প্যানা পোডে, পোডতেই থাহে। ডাইক্কা কইতে থাহে ওই আমিইন্না, চশমা লাগাইতে আছ না ক্যা, ? চশমা লাগা হমন্দির পুত। ফুড্ডুত কইররা কোনদিন আন্ধা হইয়া যাবা, হেইদিন বোঝবা আনেএহ চশমা লাগামু, ডাক্তারের ফি, গোঞ্জে যাওনের ভাড়া কি তুমি দেবা আনে চোদানির পুত।

গালির বিপরীতে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় গালি দিয়ে বসে আমিনুদ্দি। আর গালিটা দিয়েই লজ্জা পেল কেমনখানিকটা ইতস্তত করে বলে উঠল

ক্ষ্যামা দিয়েন স্যার। গাঁইয়া মানু তো, গাইল বাইরাইয়া গেছে। নিজ গুনে ক্ষ্যামা দিয়েন।

না না ঠিক আছে। কোন সমস্যা নাই। কিন্তু আপনার ডাক্তার দেখানো উচিত আসলেই। শেষে চোখ নষ্ট হইলে কেমনে হবেমাছ ধরবেন কেমন করে?

টাকা পামু কই কন, মাস ছয় আগে একদিন ফট কইররা চশমাডা গেল ভাইঙ্গা। মুই দিন আইন্না দিন খাই। এউকগা চশমা কেনতে লাগবে মনে করেন কম কইররা হইলেও আড়াইশোউগগা টাহা। ঘরের মাতারি, বালবাচ্চার প্যাড ভরাইতে পারি না, আবার চশমা। গরিবের ঘোড়ারোগ। গেল দুইবার বানের পানি ঘরে আইতে আইতেও আহে নাই। এইবার নিস্তার নাই, নিজেই তো দেইক্কা গেলেনঘরে নতুন দেইখ্যা চালা লাগামু না  চশমা কিনমু।

আমিনুদ্দির দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়। সেই দীর্ঘশ্বাসের শব্দ অবশ্য রাশেদের কানে পৌছায় না। নিচ থেকে যে জলের নাচন চলছে তাতে দুলে দুলে উঠছে নৌকাটা। আর বর্ষাধারা বয়ে চলেছে অশেষের সঙ্গীতেসমুদ্র গভীর তার শব্দ। ভুলিয়ে দেয় জাগতিক যাপনের সমস্তটুকু  

 

পাঁচ.

খুটখাট শব্দ। দরজার তালা খুলছে কেউ একজন মাথাটা কোনমতে ঢোকাতেই নেমে এলো তড়িৎ আঘাত, পেছনের দিকেই। তেমন ভারী কিছু নয়, সাধারণ একটা খোন্তা, রান্নাঘর থেকেই নিয়েছে মুসা মিয়া। বেশ কবার উপর্যুপরি আঘাতের পর জ্ঞান হারাল রজব আলী।

পুরোটা সময় অদ্ভুত সাবধানতায় ছিল লোকটা। সিঁড়িতে পদশব্দ শোনা গেলেই যেন রক্তে ছিলকে উঠছিল উত্তেজনা, দমক মেরে যাচ্ছিল পাশবিকতাযে ঘরের বাসিন্দা একজন মাত্র, সেখানে চাবি মেরে খুটখাট শব্দেই দরজা খোলে সবাই। রোজকার অভিজ্ঞতায় কারো আশ্চর্য হবার কথা নয়, ভেতরে সমস্যা ওত পাতা এমন বিষম ধারণা মনেও আসে না; বাইরে থেকে যখন সব ঠিকঠাক। কিন্তু দরজা খুলে এই যে শেষবারের মত রজব আলীর সাত রওজা রোডের তিনতলা বাড়িটার বদ্ধ খুপরিতে প্রবেশ, ভাবেনি হয়তবা

একটানা অপেক্ষায় মুসার সমস্ত শরীর বিদ্রোহ করলেও মন ছিল ঋজু, স্থৈর্য নিয়ে লুকানো বিষের চাষ করে যাচ্ছিল। দীর্ঘ আট ঘণ্টা তেইশ মিনিটের অপেক্ষার অন্তিম সময় এলো। ঠিক তা নয় আসলে, মাত্র আট ঘণ্টার অপেক্ষা সামান্য একদম। আট ঘণ্টা তো বখাটে জঞ্জালখানায়; প্রায় তিন বছর ধরেই যে ইঁদুর বিড়ালে খেলা চলছিল রজব আলীকে দেখে নেবার, আজ তার শেষধূর্ত মুসার চেয়ে রজব আলীও চালবাজিতে পিছিয়ে ছিল না বলেই বার কয়েক হাত ফসকে গেছেএমনকি হিলি বন্দর থেকে যেবার রজব ওপারের দিনাজপুরে চলে গেল তখন অল্পের জন্য ওকে ধরতে পারেনি।

বিছানায় শুইয়ে দিয়ে রজব আলীর হাত, পা আর মুখ বেঁধে নিয়েছে মুসা। অজ্ঞান রজব আলীর মুখটা পাংশু দেখাচ্ছে, লোকটা দেখতেও বেঁটেখাটো। করুণার চোখ নেমে আসছে রজবের দেহে যাতে পরিমাণ মত বিদ্বেষও লুকানোমানুষকে নগ্ন করে ফেলা মানেই শরীর থেকে সমস্ত মুখোশ খুলে ফেলা। সমস্ত অহংকার, সমস্ত আভিজাত্য ধুলোয় উড়িয়ে দেয়ান্যাংটা রজব আলীর অসহায়ত্ব দেখে মুসা ভাবছে এই অবস্থায় দেখে কে বলবে একসময় পুরো উত্তরবঙ্গ দাপিয়ে বেড়িয়েছে এই শালা। মোর্সেদ শিকদারের খাসচামচা ছিল যে লোক, তাকে কি মারার কথা ভাবতে পারত কোনদিন, কোথাকার এক মুসা মিয়া। সেই ভাবনায় চলতে থাকে মুসার মাথায় অনেকটা সময় জুড়ে সময় কেমন কইরা কামড় খেলে, কেউ কইবার পারে না। ওর হাতেই আমার মরণের কথা তিন বচ্ছর আগে আর আইজ ও মরতেছে আমারই হাতে। হা হা হা। আল্লাহ্‌ বইলা কেউ আছে তাহলে সত্যিই। নাইলে মোর্সেদ শিকদারের ফাঁসি হয়?

সিগারেট ধরায় মুসা মিয়া। ধোঁয়া ছাড়তে গিয়ে বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে যায়। আজ সে নুলা মুসা রজব আলীর জন্যে। পা কেটে ফেলে দিতে হয়েছে, না হলে মরতে হত অকালে। কী শাস্তি দিয়ে মারা উচিত ভেবে পায়না, তবে মারার আগে খেলা করা দরকার, এ নিয়ে মনে প্রশ্ন নেই। ভাবতে ভাবতেই আরেকটা সিগারেট ধরায়, সাথে এক ছিলিম গাজা মিশিয়ে নেয়। ধোয়াটা ছাড়ে নগ্ন বন্দীর ঠিক মুখের উপরেকাশি দিয়ে জেগে ওঠে রজব আলী। হাত পা ছাড়ানোর চেষ্টার সাথে বদ্ধ মুখের গোঙানি চলতে থাকে সমান তালে। এর মাঝে শুরু হল নুলা মুসার অট্টহাসিময় অপলাপ

সালাম রজব সাব, ওঠেন ঘুম থেইকা ওঠেন অহন আর লোহাগড়ায় গ্রামের বাড়িতে নাই। আপনের লাইগা কব্বরের আজাবের দিন আইজ

আরে আরে চুপ করেন মেয়াভাই, উহুহু উহুম...

কথা কওনের  চেষ্টা কইরেন না, আইজ খালি শুনবেন। আপনের ছবক লওনের দিন এইটা

রজব সাব, আপনে কি জানেন মানুষের হাতের চামড়া সবচাইয়া পাতল। এই চামড়ায় যদি আগুনের ছ্যাঁক লাগে, এক্কেরে হগল শ্যাষ। মনডায় চায় হাতখান কাইটা ফালাই।

আপনে কি জানেন এইটা ? মনে অয় না।

আহেন আপনেরে একটু জানাইয়া দেই। এইসব বিষয়ে জ্ঞান থাকন ভালা

বলতে বলতেই রজব আলীর ডানহাতটা চিৎ করে সিগারেটটা চেপে ধরল সেএকের পর এক দাগ পরতে শুরু করল আর শুরু হল চাপা গোঙানি। কিচ্ছু করার নেই রজব আলীর। চেয়ে চেয়ে দেখছে সমস্ত হাতের চামড়া থেকে গোল গোল ধোঁয়া উঠছে আর দাগ বসে যাচ্ছে বাটিক প্রিন্টের মত। আর শুনতে পাচ্ছে নুলা মুসার আক্রোশ ভরা কথাগুলো

শালা খানকির নাতি, তুই আমারে নুলা বানাইছস। মারতে চাইছিলি না? এখন দেখ কে কারে মারে। কে কারে বামন বানায় দেখ...

কয়েক ঘণ্টা ধরে নানান রকম নির্যাতন চালিয়েছে মুসা মিয়া জীবনীশক্তি প্রায় ফুরিয়ে এসেছে তারইতিমধ্যে বাম পায়ের হাঁটুর চাকতিটা নিপুণ দক্ষতায় কেটে নিয়ে পিটিয়ে গুড়ো গুড়ো করে ভাঙা হয়েছে। রাত তিনটে বাজতে চললে মুসা মিয়া সিদ্ধান্ত নেয় রাস্তা মাপার। যাবার আগে আরও মজা করতে ইচ্ছে করছে তার, মনে হয় জমছে খেলাটা, এমন আনন্দ বহুদিন মেলেনিবাথরুমে এক বোতল হারপিক দেখেছিল আগেই, সেটা ব্যবহারের সময় এসেছে এখনকাটাকুটি করা পা আর শরীরের বিভিন্ন অংশে ঢেলে দিল সমস্ত বোতল। রক্তের ভেতরে কেউ যেন আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে মনে হয় রজব আলীর। গোঙানোর শক্তি হারিয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ে সে।

মৃত্যু তার অপেক্ষাকৃত সহজ। এত এত নির্যাতনের পরে আসলে অবশিষ্ট ছিল না কিছু আর তাই বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাসরোধ তাকে মুক্তি দিল দীর্ঘ যন্ত্রণা থেকে। দুকামরার এই বদ্ধ ঘরে লাশ পরে রইল এককালে মোর্সেদ শিকদারের বহু অপকর্মের সঙ্গী; খুলনা, যশোর ও নড়াইল অঞ্চলের ত্রাস রজব আলীর। 

 

ছয়.

বছর তিনেক আগে ঘটে যাওয়া সে রাতের সমস্ত কথা মনে করতে চেষ্টা করে রাশেদ উদ্দিন। পাঠক আসুন এই ফাঁকে জেনে নেই আমরা সে রাতে ঠিক কি হয়েছিল এ নিয়ে কোন সন্দেহ থাকে না যে বর্ষার গাঁথা, অন্ধকারের গান আর স্রোতের পিরামিডের থেকে আরো বড় কিছু হয়েছিল সেদিন। সে রাতে আমিনুদ্দির সাথে মাছ ধরা নিয়ে কথা হচ্ছিল। একসময় রাশেদ ও আমিনুদ্দির খুচরো কথা, যাপিত জীবনের লেনদেনের আলোচনায় ভাটা নামে বলবার কথা ফুরিয়ে আসে কিন্তু বিষকাঁটালি নদীতে বৃষ্টির বিরাম হয় না। মনে হয় আকাশটা যেন অনবরত কেঁদে চলছে। যে কান্নার শেষ হতে হতে নুহের মহাপ্লাবনের মত সমস্ত পৃথিবী ঢেকে যাবে জলের আচ্ছাদনে। এসময়ে উপরের বালু বোঝাই জাহাজটাতে কি হচ্ছে জানত না নীচে নৌকোর আশ্রয় নেয়া লোক দুটো।

হঠাৎ শোনা যায় গুলির শব্দ আর তারস্বরে চিৎকার। ওরা বিস্ময়ে স্তব্ধ। এই অন্ধরাত্রি যতটা শব্দ করছে তা থেকে একচুল বেশি শব্দ যেন না আসে তার চেষ্টা চালাতে থাকেসে অবস্থাতেই শুনতে পায় ঝুপ করে জলে এক মানুষের ঝাঁপিয়ে পড়ার শব্দ। না পড়ে যায়নি, ধাক্কা মেরে ফেলা হয়েছে। উপর থেকে চলছে নীচে ফেলা লোকটিকে উদ্দেশ্য করে খিস্তি খেউরের বন্যা

হালা বেশ্যা মাগীর ছাওয়াল, খুন চোদাতি গিছিলে না?

জাইন্যা টাহা খাতিস জয়নাল চেয়ারম্যান ক্যাডা

শয়তানের বাচ্ছা। পাখনা খুব বাড়িছে, একাবারে ভাইঙ্গে দিছি। এখন নদীতে ভাইসে ভাইসে চোদা খাতি থাক, যাদেহি তোর কেমন মুরোদ, পারলি আসিস আমাক খুজতি। লোহাগড়ার রজব আলী আমি, তোর মত একশ মুসারে আমি বিয়ান বেলা থাকি চুদতি চুদতি ন্যাদা বানাতি পারি

আরেকটি শব্দ হল নদীতে। ধাতব কোন কিছু ফেলার শব্দ। এই সময়ে নৌকাটা বেশ জোরে দুলে উঠল ঢেউয়ের তোড়ে। বেশ শব্দ করে বাড়ি খেল জাহাজটার সাথে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবুদ্ধি হয়ে চিৎকার দিতে গেল রাশিদউদ্দিন। তার মুখ চেপে ধরল আমিনুদ্দি। ওদিকে শব্দ পেয়ে লোকটা উল্টো দিকে টর্চ ফেলে বলে উঠল, কেডারে, কেডা কতা কতিছে এখানে, শব্দ হতিছে কিসের?

দাঁতে দাঁত লাগিয়ে জাহাজের গায়ে হেলান দিয়ে থাকল ওরা। মিনিটপাঁচেক সাড়া শব্দ না পেয়ে গান ধরে উল্টো দিকে হাঁটা দিল সে। লোকটা চলে গেছে নিশ্চিত হবার পরে কথা বলে উঠল রাশেদ

ভাই লোকটা তো মারা যাবে মনে হচ্ছে। ওকে উদ্ধার করতে হবে। আপনে নৌকা আগান। খোঁজ লাগান।

আমনে কি পাগল হইছেন মেয়া। ও ব্যাডারে মউতের ঘরে হান্দায়া দেছে কিনা কেডা কবেআর কয় কাল আগে ফেলাইছে চিন্তা কইররা দেহেন। আধাঘণ্টা প্রায় অইছে নাহি ঠিক নাই। আর এই তুফানি নদীতে আমনে মানুডারে খুঁইজা পাইবেন কোম্মে

কি বলেন আপনি। একটা লোক মরে গেছে না বেঁচে আছে ঠিক নেই, বাঁচানোর চেষ্টা করব না? আসেন, নৌকা আগান।

নৌকা নিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এগিয়ে গেল আমিনুদ্দি। আসলে অনিচ্ছার পেছনে ছিল ভয়। খুন হতে যাওয়া একজন লোককে উদ্ধার করতে যাওয়া মানেই থানা পুলিশ। মরে গেলে তো কথাই নেই। জাহাজের উল্টো দিকে নৌকাটা নিয়ে যেতেই চিৎকার দিয়ে রাশেদ বলে উঠল

এই যে ভাই, আপনে কই? আপনারে যে ফালাইল

এই যে ভাইআপনে কইআপনারে যে ফালাইল আপনে কই আছেন সাড়া লন।

কিন্তু এদিকে কোন জনমানবের ছায়া নেই। বৃষ্টি এখনো ঝরছে তবে বেগ কিছুটা কমতির দিকে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজেই নৌকা নিয়ে খোঁজা হচ্ছে বেঁচে থাকা কিংবা মেরে ফেলা অজ্ঞাত লোকটাকে।

আধঘণ্টা ধরে খোঁজাখুঁজি চলল। মাঝ নদীতে দুজন লোকের উদভ্রান্ত চিৎকারের পর অবশেষে শোনা গেল ক্ষীণ এক আওয়াজ। শব্দটা কাছেই মনে হল রাশেদের। আরও জোরে চিৎকার দিয়ে বললভাই আপনে কইআপনারে খুঁজতেছি। শব্দ করেন জোরে। লোকটা সাড়া দিল প্রাণশক্তির সবটা এক করে এবারে ওরা দেখতে পেল তাকে। নৌকা আর লোকটার মাঝে ব্যবধান দেড়শ ফুটের মত। এমন সময় রাশিদ উদ্দিন এক উদ্ভট কাজ করে বসলেন। নদীর এই তুমুল স্রোতের মাঝে কোথায় রয়েছে সে না ভেবেই দিল এক লাফ। লোকটাকে উদ্ধারের বাসনায় ভুলে গেল সাঁতারে দক্ষ হলেও এ নদী প্রমত্তাবর্ষার নদী। যার একুল ওকুলের বোঝাপড়া করা এই দরিয়াপারের লোকের জন্যেও কঠিন। রাশেদ কোন মতে লোকটার কাছে পৌঁছল কিন্তু লোকটাকে নিয়ে ভেসে যাচ্ছিল এদিকে নৌকা নিয়ে আগাতে থাকা আমিনুদ্দি গলা চড়িয়ে জানান দিল আপনেরা ওইখানেই থাহেনভাইসা যাইয়েন না। আমি আইতে আছি। একটু খাঁড়ায়া থাহেন

প্রবল স্রোত ওদের ভাসিয়ে নিচ্ছিল। আমিনুদ্দি এসে নৌকার বৈঠাটা বাড়িয়ে দিল রাশেদকে। লোকটাকে আগে ঠেলে উঠিয়ে দিল রাশেদ। আমিনুদ্দি ধরাধরি করে নৌকায় শোয়াল লোকটাকে। এরপর রাশেদ উদ্দিনও উঠে বসল আমিনুদ্দি নৌকায় হেলান দিয়ে শুয়ে পড়া রাশেদকে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন-

এইডা কোন কাম হরলেন আপনে। এইভাবে কেউ ফাল দিয়া নাইম্মা যায় দরিয়ায়আপনে ভাইসা গেলে কেমন হইত কতাডা? মোরে বদনামের ভাগিদার বানাইতেন।  

 

সাত.

 

আকাশ জুড়ে অগুনতি নক্ষত্র। অপার বিস্ময়ে শতসহস্র চোখ নিয়ে ওরা চেয়ে আছে নীচের দিকে। সম্ভবত দেখে দেখে অবাক হচ্ছে কি আশ্চর্যের নিয়মে এখানে তাবৎ কুৎসিত বাসা বেঁধেছে, রোদ ফুরাতে লিখে যাচ্ছে টুকরো স্বপ্নের অলিখিত মৃত্যু কিন্তু তবুও যাপন কি এক অগোছালো আনন্দে হেসে ওঠে। ওপরের তারাদের যেমন আরও ওপরে তাকাবার সুযোগ নেই তেমনি নীচের মানুষদের সুযোগ নেই আরও নীচে তাকানোর। স্বর্গ ও নরক বোধহয় চিরকালই তাই মানুষের চেতনার বাইরের কিছু। চির অচলের বিধিবদ্ধ নিয়মেই একটু আগে খুন করে আসা নুলা মুসা এখন তারা দেখছে। খুনে চোখদুটোও এখন বিস্ময় নিয়ে দেখছে অপার্থিব আকাশের ফুল।

নীলফামারী যাবার জন্যে সায়েদাবাদ থেকে বাসে উঠেছে দিন একদম গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে। ভারত চলে যাবে নাকি কোন ছিটমহল ধরে, ভাবছে সে। বাস ছাড়ার অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই দিনের তাপে ক্লান্ত লোকগুলো ঘুমিয়ে পড়েছে সব। নুলা মুসা ভাবছে বেঁচে থাকার কি কথা ছিলএইভাবে। বর্ষায় উত্তাল বিষকাঁটালিএমন বিপুলধারা স্রোতএকেকটা ঢেউ উপরে তুলে যেন আছার মারে আজরাইলের শক্তিতে। এমন মাতাল নদীতে পায়ে গুলি খাওয়া মুসা মিয়ামৃত্যুকে একেবারে সামনে দাঁড়ানো দেখেছে। দোজখের দুয়ার খুলে চুম্বক দিয়ে যেন টানছিল মৃত্যু, এমন অবস্থা থেকে তাকে টেনে বের করে আনল ওই সাংবাদিকটাকি যেন নাম। বারবার মনে করার চেষ্টা করল কিন্তু মনে এলো না কিছুতেই। উত্তেজিত হয়ে উঠল সে। মাথা চুলকে চুল ছিঁড়ে ফেলার দশা করল, বিষম উত্তেজনায় সামনের সিটের পেছনটাতে একটা লাথি মারল, সেখানে বসা বাচ্চা ছেলেটা উঠে গেল আর মুসার দিকে চোখটা একটু ফিরিয়েই আবার ঘুমিয়ে গেল। তবুও মনে করতে পারল না লোকটার নাম। হঠাৎ চোখ থেকে এক ফোঁটা জল নেমে এল। এ জল কি কৃতজ্ঞতা থেকেই, নাকি মাথায় আঘাতজনিত কারণে বোঝা মুশকিল।

মুসার মনে পড়ে দুদিন পরে হাসপাতালে জ্ঞান ফিরল। রোগীর ভর্তির সময় কি একটা নাম দেয়া হয়েছে সেটাও মনে পড়ছে না তার। ডাক্তার জানালসাংবাদিক সাহেব নিয়ে এসেছেন। পায়ের বাটি বরাবর গুলি লাগায় একেবারে গুড়ো গুড়ো হয়ে গেছে, তাই বাম পা কেটে ফেলতে হয়েছে। ডাক্তার দুঃখপ্রকাশ করে জানালেন, ‘আর ভয় নেই। কাল সকালে পুলিশ এসে তাকে কে মেরেছে এই নিয়ে জবানবন্দী নেবে। যদিও জানে না ডাক্তারমুসা মিয়া যে আজ থেকে নুলা মুসা হল; সে কিছুতেই ভয় পায় না আর আগে পেলেও এখন সে মৃত্যু দেখে আসা লোক। ভয় তার দিনতিনেক আগেই ডুবে গেছে জলে রাত নামতেই ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র ও হাসপাতালে ভর্তির কাগজগুলো সব নিয়ে হাসপাতাল থেকে এক ফাঁকে পালিয়ে যায় দূরে কোথাও।  

 

আট.

 

পেঁয়াজ কাটার সময় যেমন একের পর এক স্তর তুলে আলাদা করে ফেলার পরেও যেমন দেখা যায় তবুও বাকি অনেকঠিক তেমনি জয়নাল চেয়ারম্যানের আত্মহত্যা কিংবা খুনের ঘটনাবেশ কয়েকটি দৈনিকে যা এসেছিল— শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে কয়েকটা ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট। যদিও ঘটনাগুলোর বেশ কয়েকটি ঘটবার কথা ছিলনা আদৌ। মর্মান্তিক এই ঘটনাগুলো ঘটে যাবার পেছনে রাশেদ অনেকাংশেই দায়ী এই ভাবনা তাকে এক ধরণের চাপা অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। পুরো বিষয়টা নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে বিস্মিত হয় রাশেদগত সপ্তাহ তিনেক বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহে ধকল গেছে বেশ। অনুমিত ভাবেই পুলিশের তরফ থেকে ময়নাতদন্তের ফলাফল নিশ্চিত করে— এ আসলে খুনকোনমতেই আত্মহত্যা নয়। ধারালো ছুরি দিয়ে কেউ একজন আঘাত করেছে লোকটার কণ্ঠনালীতে। মৃত্যু বলতে গেলে সাথে সাথেই। আশ্চর্য ব্যাপারখুনির হাতের ছাপ পাওয়া যায়নি ছুরিতে। উল্টো মৃতের হাতের ছাপই ফুটে আছে ওতে। এমনকি আত্মহত্যার সময় যে চিরকুট পাওয়া গিয়েছিল সেটাও চেয়ারম্যানের হাতেই লেখা।

চোখের আলোর রিপোর্টার মোশতাক জহিরের সাথে কথা বলে জানা যায় জয়নাল চেয়ারম্যানের সাথে এলাকার আরেক প্রভাবশালী আজগর চাকলাদারের দ্বন্দ্বের কথা। এলাকার লোকের কাছেই জহির শুনেছেজয়নাল চেয়ারম্যানের চ্যালা চামুণ্ডাদের সাথে দুবার চর দখলের লড়াইয়ে হেরে গিয়েছিল চাকলাদারের লোকেরা। এমনকি চেয়ারম্যান নাকি চাকলাদারকে গুম করার হুমকিও দেয় একবারহাট ভরা লোকের সামনে। তথ্যটা রাশেদের মনে জমে থাকা সন্দেহকে প্রায় সত্যি করে তোলেঅন্তত কার্যকারণ তাই বলে।

অদ্ভুত এক অস্থিরতা ঘিরে ধরে রাশেদকেনিজের মনেই সাজায় যুক্তিজাল। সেই বর্ষারাতআকাশ থেকে অঝোর বর্ষণ আর উপর থেকে রজব আলীর তর্জন গর্জন। নুলা মুসাকে মেরে ফেলতে চাওয়া রজব আলী চাইছিল লাশ ভেসে চলে যাক সর্বনাশা বিষকাঁটালিতে। তাই প্রাণে না মেরে পায়ে গুলি করে ফেলে দ্যায় উত্তাল নদীতে। আর সে হত্যা চেষ্টার পেছনে যদি চাকলাদারের হাত থাকে তবে এর অর্থ একটাইজয়নাল চেয়ারম্যানকে হত্যার জন্য মুসাকে ভাড়া করেছিল চাকলাদার। কোনভাবে আগেই টের পেয়ে যায় চেয়ারম্যানের লোকেরা আর তাই পোষা গুণ্ডা রজব আলীর মুসাকে হত্যাচেষ্টা। ব্যালকনিতে রাখা চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ভাবতেই রাশেদের গাহাতপা কেমন ঠাণ্ডা হয়ে আসে। সমস্ত পরিষ্কার হয়ে যায় তার কাছেমাসখানেক আগে খুন হওয়া শীর্ষসন্ত্রাসী রজব আলীই কি তবে সেই রাতের লোকটাযে আটকে যাওয়া জাহাজের উপর থেকে খিস্তি উড়াচ্ছিল আর নীচে ফেলে দিয়েছিল আরেক সন্ত্রাসী মুসা মিয়াকে। আরও আগে কেন এই সংযোগ খুঁজে পেল নাভেবে নিজেকে ধিক্কার দিল রাশেদ। তিন বছর আগে বন্যাপর্বের নদীতে পার করা রাতে যাকে জীবনবাজি রেখে উদ্ধার করেছিল কালক্রমে সে যে শীর্ষ সন্ত্রাসী নুলা মুসা হয়ে উঠবে কল্পনায়ও আসেনি রাশেদের। নুলা মুসা যদি জয়নাল সাবকে নাও খুন করেরজব আলীর খুন হবার পেছনে এর চেয়ে যৌক্তিক কোন কারণ নেই।

আততায়ীর মত একটি রাত অনেক প্রশ্নের উত্তর আর কিছু মৌলিক অন্ধকার দিয়ে গেল স্বাপ্নিক রাশেদকে। যে অসম সাহসী কাজের জন্য কদিন আগেও ছিল গর্বের অনুভূতিআজ চূর্ণ হয়েছে তা যেন মুহূর্তেমাত্রের অন্ধকারে। সারারাত নির্ঘুম লোকটা এখনো জানে না কি করে পার করবে আরও দীর্ঘ দুটো ঘণ্টাবেহায়া সময় যে নগ্ন হয়ে বসে আছে রাতের কোলে চড়ে। শেকল পরা এই এক প্রহরের অপেক্ষা শেষ হলে রাশেদ মুক্ত হবেসকাল আটটা বাজতেই সে বেড়িয়ে পড়বে জবানবন্দী দিতে। পুলিশের কাছে গিয়ে সব খুলে না বলা পর্যন্ত জলপানও তার কাছে বিষাক্ত মনে হচ্ছে। এমন একটা মহৎ কাজের সাথে জগত সংসার এহেন পাপ মিহি সুতোয় বোনা জালের মত মিশে থাকবে একদম জানা ছিল না রাশেদের।

 

নয়.

 

রাত এগারোটা। দুটো টিকেট কাটা হয়েছে এইমাত্র বেতদিঘী বাসস্ট্যান্ড থেকেঅথচ যাত্রী রয়েছে একজন। টিকেটের গায়ে যাত্রীর নামের জায়গায় লেখা হয়েছে মোঃ গফুর মিয়া। বাসের গন্তব্য ফুলবাড়ি থেকে ঢাকা। অমাবস্যার ঘোর এই অন্ধরাতে আরও যারা বাসে উঠেছেন তারা জানেন না কে এই গফুর মিয়াকি তার আসল পরিচয়। যারা জানে লোকটাকে তারা দুটো দলে বিভক্তএকদলের বেশিরভাগ আর বেঁচে নেই যে অন্যদের সাবধান করে দেবে আর আরেকদল তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছেজীবিত অথবা মৃত ধরিয়ে দিলে কিংবা যে কোন সংবাদ দিতে পারলেই নাকি দুলক্ষ টাকা পুরষ্কার ঘোষণা করেছে। রাতের বাসঘুটঘুটে অন্ধকারে চলতে শুরু করে। বেশ খালি খালি থাকতেই বাস ছেড়ে দিল। লোকটার আরও বেশ কিছুদিন বিশ্রামের ইচ্ছে ছিল। মালদায় গিয়ে বেশ আরামেই ঘুমিয়ে কাটিয়েছে বেশ কিছু দিন। মদমেয়েছেলেজুয়ার আসর কোনকিছুরই কমতি ছিল না একদম যাকে বলে পরিপূর্ণ উপভোগ। হঠাৎ করেই খবর এলোআরেকটি কাজ নাকি এসেছে সামনে। এবারের কাজটা খুব সাবধানে করতে হবেমনে মনে কথা চলে নিজের সাথেহুঁশিয়ার আততায়ীর। সে ভাবনায় অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্য প্রকাশ পায় খুন হবার অপেক্ষায় থাকা লোকটিকে নিয়ে।

এবারের বাছাধনের কাজকাম নাকি আবার ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং। এই সাংবাদিক গুলা বহুত খতরনাক আছে। একটা মরলে ঝাঁক ধরে আসে। শালার বেক্কেল রাস্কেল টের পায় নাই যে মরণ চইলা আসছে ইনভেস্টিগেশন চোদাইতে চোদাইতে। ‘‘জয়নাল চেয়ারম্যানের খুনি কে?’’ এই নাম দিয়া নাকি পেপারেও লিখতেছে কিসব। চাকলাদার সাব জয়নাইল্যার খুনে জড়িত থাকতে পারে এইসব কথাবার্তাও বাতাসে চাউর করেছে পাগলাচোদাটা।’ মনে মনে ভাবেভাবতে ভাবতে অট্টহাসি দেয় চারপাশ কাঁপিয়ে পরাণ পাখিটা উইড়া গেলে শালার গোয়া দিয়া সাংবাদিকতা ছুইট্টা যাইব

 বাসের পাঁচজন যাত্রীর মাঝে যারা ঘুমে ঢলে পরেনি তারা নতুন নাম নেয়া গফুর মিয়ার দিকে ফিরে তাকায়, মিনিট দুয়েক তাকে দেখার পর আবার গতানুগতিক নিদ্রাচ্ছন্নতার প্রস্তুতি নেয়

পেছন থেকে দুই সিট আগে বসে আছে অদ্ভুত লোকটা। কাঁথা মুড়ি দিয়ে আয়েশ করে দুটো সিট নিয়ে গা এলিয়ে দেয়। গত মাস দেড়েকের নির্ভাবনার দিনগুলো শেষ হল ভেবে মুখটা একটু শক্ত হয়ে আসে তার।

...

লেখক পরিচিতি

0 Comments
Leave a reply

পাগলি

15 November, 2021 | : মৃদুল শ্রীমানী

আমাদের স্টিফেন হকিং

11 November, 2021 | : মাখনলাল নন্দগোস্বামী

কৌশিক দাসের দুটি কবিতা

11 November, 2021 | : কৌশিক দাস

বর্ষামাত্রিক

15 November, 2021 | : রেজওয়ান তানিম