পাগলি

By : মৃদুল শ্রীমানী | : 15 November, 2021
পাগলি

সুতপা বুঝতে পারে না ঘটনাটা কী ঘটল এই তো দিন আগেই তার বাবা দাদা মিলে তাকে বুঝিয়েছিল মামলা একটা করা দরকার সুতপা বলেছিল, “যে বর তাড়িয়ে দিতে পারে, তার কাছে আর ফিরে যাব না, আর হাত পাততেও পারব না বরং কিছু কাজ খুঁজে দাও আমাকে খেটে খাব 
দাদারা জেদ করতে অনিচ্ছায় ওকালতনামায় সুতপা সই করে দিয়েছিল এক রকম না তাকিয়ে বিড় বিড় করে বলেছিল“যে ভালবাসে না, তার কাছে চাইব কোন লজ্জায়?
উচ্ছ্বাসকে এখন দেখতে আরো একটু ভাল লাগছে যেদিন ওদের বাড়ি থেকে প্রথম দেখতে এসেছিলসেদিনও এমন ভাল লেগেছিল কেমন চনমনে ভাব সুতপা ভেবেছিলআমার কপালে কী ডাক্তার পাত্র জুটবে?
বাবা বলেছিল“জুটবে জুটবে, কি মিষ্টি মুখখানি তোর ! যে দেখবে সে গলে যাবে লজ্জা পেয়ে মেয়ে বলেছিল“নিজের মেয়ে বলে বাড়িয়ে বোলো না বাবা, আমি খুব বেশি হলে সুশ্রী সুন্দরী যাকে বলে সে আমি নই
বাবা চিবুক ছুঁয়ে বলেছিলেন“তুই খুব সুন্দর যা জানতে চাইবে মন খুলে জবাব দিবি
সে সব সুতপা পারে ভারি সহজ সরল সে না ভেবেই ঠিক ঠিক বলে দিতে পারে তবে পরের বাড়ির লোকে কীভাবে নেবে তাকে সে ভরসা পায় না উচ্ছ্বাসের বাবা বড়ো জ্যোতিষী দাদারা দেখে এসেছে, ওঁর চেম্বারে সর্বদা ভিড় লেগে থাকে প্রতি অমাবস্যায় মৌনী থেকে যজ্ঞ করেন তিনি স্পেশ্যাল সিট বুক করে আসেন লোকাল লিডাররা পর্যন্ত উচ্ছ্বাসের দাদাও জ্যোতিষী আস্তে আস্তে নাম ডাক ছড়াচ্ছে এখনই বিজ্ঞাপনে ওর দাদা বিজনের নামের পাশে মহর্ষি কথাটা লেখা হচ্ছে সুতপার ভয় হয়, এইসব মুনি ঋষিদের তপোবনে সে মানিয়ে নিতে পারবে তো?
দাদারা হেসেছিল “তপোবন না ছাই বাড়িতে এসি , ফ্রিজ , গাড়ি, ওয়াশিং মেশিন কী নেই? তোর কোনো কষ্ট হবে না তা ছাড়া তোর শ্বশুর ভাসুর দুজনেই তোর কুষ্ঠি ঠিকুজি খুঁটিয়ে দেখেছে লগ্ন, গণ একেবারে খাপে খাপে মিলে গিয়েছে তোদের শ্বশুর তোর নিজেই বলেছে একেবারে রাজ যোটক সুতপার ভয় ভয় করে মানুষের জীবনের হিসেব নিকেশ অতো দূরের গ্রহ নক্ষত্রে গোনা গাঁথা আছে? আবার হয় না কি?
উচ্ছ্বাস প্রথম রাতেই জানতে চেয়েছিল – “তুমি এতো কোল্ড কেন? ফ্রিজিডিটি আছে না কি তোমার?
সুতপা বলেছিল“আমায় একটু সময় দিন আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে উচ্ছ্বাস নার্সিং হোমে বেশি সময় দিত লোকে বলত, গর্ভপাতে আজকাল অনেক টাকা সুতপার ভেতরটা কাঁদত আহা , মেয়েগুলোর পেট থেকে ওভাবে বাচ্চা খসিয়ে আনে? নরম বিছানায় আবছায়া আলোয় উচ্ছ্বাসকে দেখে তার ভয় পেত এই হাতে উচ্ছ্বাস কতগুলো বাচ্চাকে খসিয়ে এনেছে?
বিরক্ত হয়ে উচ্ছ্বাস বিছানা ছেড়ে চলে যেত একদিন বিরক্ত হয়ে ড্রাইভারকে বলল“ওকে ফালাকাটায় দিয়ে আয় ওদের বাড়িতে কিন্তু তুই ঢুকবি না
সুতপা বুঝতে পেরেছিল সে উচ্ছ্বাসের অপছন্দের বউ মা যখন তখন চোখে আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদত কখনও ঘন্টার পর ঘন্টা ঠাকুর ঘরে বসে পুজো করত বউদিরা তাকে রান্নাঘরে ঢুকতে দিত না বলতো, “থাক মিনি, আমরা সামলে নিচ্ছি সুতপার নিজেকে বড়ো বেখাপ্পা মনে হত
কোর্টে উচ্ছ্বাস বলে বসলো যে তার বউ পাগল অশিক্ষিতের সাথে তবু ঘর করা যায়, কিন্তু পাগলের সাথে ঘর করা যায় না সুতপা দেখছিল, উচ্ছ্বাস টাইটা খুব সুন্দর করে বেঁধেছে বিচারক বললেন, “অশিক্ষিত বলবেন না, মেয়েটি একজন গ্রাজুয়েট উচ্ছ্বাস কাঁধ ঝাঁকিয়ে একটু বিরক্তি প্রকাশ করে বলল“হ্যাঁ, সংস্কৃতে পাশ গ্রাজুয়েট ঠোঁটের ভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল, একজন গাইনি সার্জনের তুলনায় একটা পাশ গ্রাজুয়েট অশিক্ষিতের সামিল সুতপা জানে ওই রকম কাঁধ ঝাঁকানোকে শ্রাগ করা বলে বডি ল্যাংগুয়েজ বলে একটা কথা আছেসেটাও সুতপার মনে পড়ে কোর্টে ওরা কী সওয়াল করে সুতপার মাথায় ঢোকে না কী দরকার বাবা, যখন ভালবাসে না , তখন জোর করে কী লাভ?
বিচারক উচ্ছ্বাসকে বললেন, “দেখুন আপনি একজন ডাক্তার আপনার কাজ রোগীকে ভাল করা আপনার বউয়ের সাথে আমরা তো কথা বলেছি তিনি সহজ সরল হতে পারেন, পাগল নন একটু মানিয়ে নিন সফিস্টিকেটেড না হলেই তাকে পাগল বলতে নেই সুতপা দেখতে পায়, বিচারকের মাথার পিছনে গান্ধীজির ছবিটিতে একটু ঝুল লেগে আছে তার ইচ্ছে করে, মহাত্মার ছবিটি আর একটু পরিষ্কার করে দেয় ততক্ষণে একটা ডেট পড়ে যায় 
পরদিন বিচারকের কাছে বাবা দাদা এক বাক্যে স্বীকার করে, সুতপা পাগল উচ্ছ্বাসের সাথে পাগলের বিয়ে দিয়ে তাঁরা অপরাধ করেছেন তেতো গলায় বিচারক প্রশ্ন করেন, “তা সে কথাটা শুনানির প্রথম দিনে মনে পড়েনি? সেদিন কি কেউ বারণ করেছিল এসব বলতে?
বাড়ি ফিরে এল সুতপা পরদিন ঘর মুছতে মুছতে কাজের মেয়ে বিড়বিড় করে বললো“টাকার জুতো মেরে তোমাদের মেয়েকে পাগল বানিয়ে দিল ষোলো লাখ টাকা অনেক টাকা জানি, তবু সুস্থ ভালোমানুষ মেয়েটাকে পাগল বদনাম দেবে? তোমাদের ভদ্র ঘরেই চলে আমরা ছোটলোকেরা এসব ভাবতেই পারি না 
সুতপা সব শুনে না শোনার ভান করল দুপুরে তার খিদে পেল না কিছুতেই পাতের ভাতগুলো একটু নাড়া চাড়া করে টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ল
বিকেল বেলা খুব ভ্যাপসা গরম ছিল মা বলেছিল“মিনি গা ধুয়ে নে , আরাম পাবি সুতপা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সাথে কী হিসেব নিকেশ করছিল প্রতিবিম্বের কাছে কী সব গুহ্য কথা জানতে চাইছিল এক বউদি বলল, “মিনি সন্ধে হয়েছে, গা ধুয়ে চুল বেঁধে নাও” মেয়ে যেন কানে শোনে না নাটকের পার্ট মুখস্থ করার মত করে কোর্টের ভেতর বিচারকের সাথে উচ্ছ্বাসের যে সব কথা হয়েছিল হাত পা নেড়ে সে সব আবৃত্তি করতে থাকে  
মা তার বাবাকে ডাকল “দ্যাখো , মিনি কথা শুনছে না বাবা বাংলা ক্রশ ওয়ার্ড পাজল ছেড়ে উঠে এলেন মৃদু স্বরে বললেন “কী হচ্ছে মিনি? কী বকছিস পাগলের মতো? ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় মেয়ে, তার রোষ কষায়িত চোখ দেখে ভয় পান বাবা এবার দাদা এগিয়ে আসে ধমকে বলে, “কী করছিস পাগলের মতো?
চিরকালের শান্ত সুবোধ মেয়েটি যেন বদলে গেল অন্য একটা অস্তিত্ব বেরিয়ে এল সেই ভর সন্ধ্যায় একটা চীৎকার দিয়ে এলো গায়ে বাড়ি থেকে দ্রুত বেরিয়ে গেল একটা সোমত্ত মেয়ে শহরতলির আলো আঁধারিতে রাস্তার ধারে তাস খেলতে থাকা লোকেরা উলঙ্গ পাগলি দেখে ঢিল ছুঁড়ল কুকুরেরা কোন অমঙ্গল আশঙ্কায় অকারণে চীৎকার জুড়ল দুজন ভদ্রলোক যেতে যেতে নিচু স্বরে বললেন“যা গরম পড়েছে, অনেক লোক পাগল হয়ে যাবে

পাগলি সে সব কানেও নিল না

লেখক পরিচিতি

0 Comments
Leave a reply

পাগলি

15 November, 2021 | : মৃদুল শ্রীমানী

আমাদের স্টিফেন হকিং

11 November, 2021 | : মাখনলাল নন্দগোস্বামী

কৌশিক দাসের দুটি কবিতা

11 November, 2021 | : কৌশিক দাস

পাগলি

15 November, 2021 | : মৃদুল শ্রীমানী