বিজ্ঞানের কী উত্তরাধিকার আমরা বহন করবো ?
শুভাশিস মুখোপাধ্যায়
চন্দ্রায়ণের সাম্প্রতিক সাফল্যের পর “প্রাচীন ভারতীয় বিজ্ঞান”-এর পক্ষে যেভাবে জনমত গঠন করার চেষ্টা হচ্ছে, তাতে রাজনৈতিক দলবিশেষের আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে আপেক্ষিক সুবিধে হলেও হতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলি, বিশেষত যে দলগুলি ধর্মীয় আবরণের অন্তরালে মুখ লুকিয়ে বিশেষ রাজনীতির চর্চা করে, তাদের কাছ থেকে এই বিষয়টি খুব একটা অপ্রত্যাশিত কোনও আচমকা পদক্ষেপ করা নয়। কিন্তু যখন বিজ্ঞানী বা প্রযুক্তিবিদ বলে চাকরি পাওয়া মানুষরা, যাঁরা আমাদের দেশের বিভিন্ন জাতীয় বিজ্ঞান সংস্থার উচ্চপদগুলি আলো করে বসে আছেন, তাঁরা যখন এই বিজ্ঞানবিরোধী রাজনীতির আসরে নেমে রাজনীতির মানুষদের বাড়তি অক্সিজেনের জোগান দেন, তখন সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়ে ভাবেন যে এই বিজ্ঞানী বলে বর্ণিত মানুষরা কি স্বেচ্ছায় এই কাজ করছেন, নাকি ক্ষমতার অধীশ্বরবৃন্দ তাঁদের দিয়ে এই কাজ করিয়ে নিচ্ছেন, অথবা তাঁরা নানা কারণে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে, দারা-পুত্র-পরিবারের সুরক্ষার চিন্তায় বিজ্ঞানী হয়েও এমন অপবিজ্ঞানের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন।
সরকারি আমলা বিজ্ঞানীদের সরকারপ্রীতি সুবিদিত। তাঁদের ডলার রোজগার,বিদেশভ্রমণ,সীমাহীন সরকারি সুযোগ-সুবিধা—এই সব কেজো জাগতিক মোহ ও মাৎসর্য-এর মোহিনী হাতছানি উপেক্ষা করে বিজ্ঞানকে আঁকড়ে ধরে ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দকে বিদায় জানানোর মতো সাহসিক ও কষ্টকর কাজে তাঁরা সহসা উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠবেন, এমন আশা করা নিতান্তই দুরাশা। আমাদের ছাত্র জীবনের একটি আন্তর্জাতিক আলোচনাচক্রের একটি অভিজ্ঞতার কথা এই সূত্রে মনে পড়ে গেল। আলোচনাচক্রটি ছিল ভারতে দারিদ্র্যের স্বরূপ ও তার প্রতিকার সংক্রান্ত। তখন ভারতের যোজনা কমিশন ভারতের পাঁচশালা পরিকল্পনা করা ও তার রূপায়ণের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা। বাঘা বাঘা এবং বাছা বাছা ব্যক্তিবর্গ ভারতে দারিদ্র্যের স্বরূপ ও প্রতিকার নিয়ে কঠিন গাণিতিক ফর্মুলা মারফৎ দারিদ্র্য দূরীকরণের নানান পথ বাতলাচ্ছেন। অধিবেশনের শেষ অংশে ছাত্রদের প্রশ্ন করার অধিকার দেওয়া হয়। একজন ছাত্র ( আজকের একজন নাম করা উন্নয়ন-অর্থনীতির প্রতিষ্টিত গবেষক) কর্তাদের হাজির করা মডেল ও যুক্তিধারার মধ্যেকার ফাঁকটি বেপর্দা করে এক বেমক্কা প্রশ্ন করে বসেন— কী করে কর্তাব্যক্তিরা অর্থিনীতির অ-আ-ক-খ উপেক্ষা করে এমন সব অবাস্তব তত্ত্ব আমদানি করতে পারেন,তাঁদের কি চর্চিত বিষয়টির প্রতি বিন্দুমাত্র দায়বদ্ধতা নেই? মৌচাকে এই “ঢিল”-টি নিক্ষেপ করার পর বেশ কয়েকজন সরকারি অর্থনীতিবিদ মিন মিন করে স্বীকার করে নিয়ে বললেন,“ইয়ং ম্যান, আমরা সবাই ‘পার্ট-টাইম ইকনমিস্ট’, ‘ফুল-টাইম সরকারি কর্মচারী’, কর্তার ইচ্ছায় কর্ম।“
আজকের এই সর্বব্যাপী এমন “ফুল-টাইম” কর্তব্যনিষ্ঠ কর্মচারীদের দেখে এই প্রশ্নটি আবার নতুন করে মনে আসতে শুরু করেছে। সত্যিই কি একজন উপাচার্যকে বলতেই হয় যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, যাঁর বিজ্ঞানে অদক্ষতা সংশয়াতীত, তিনি বিজ্ঞানী নিউটন-এর চেয়ে বেশি ধীশক্তি সম্পন্ন বিজ্ঞানী? একজন ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার উপাচার্যকে ‘জাতীয় যোগ দিবস”-এ হাফ-প্যান্ট পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তায় বসে-শুয়ে-নিল-ডাউন হয়ে তাঁর সরকারের প্রতি অনুরাগ প্রদর্শন করতে হয় এবং বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের উচ্চাসন গ্রহণের পথ সুগম করতে হয়?
আমাদের আরও মনে পড়ছে সেই ছাত্র জীবনের অন্য এক কথা। ভিয়েতনামে ভয়াবহ বিমান আক্রমণে যখন অগণিত নারী-শিশু-বৃদ্ধা-বৃদ্ধের মৃত্যু ঘটায় বহিরাগত আগ্রাসক মার্কিন সেনারা, তখন মার্কিন দেশের একজন অত্যন্ত বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ নিক্সন প্রশাসনের কাছে তাঁর পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে লেখেন, “ you have put in an insult on academics by equating myself with those intellectual prostitutes that you have hired to parrot your aggressive stance and killing millions of people in the name of ‘saving democracy’.”
আমাদের দেশের বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রকাশ্যেই বলতেন এবং তাঁর রসায়নের ইতিহাসের বইতে লিখে গেছেন কীভাবে মানবজাতির জ্ঞানভাণ্ডারে নানান গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান সংযুক্ত করেও আমাদের দেশ কেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পেছিয়ে পড়লো। যে অপবৈজ্ঞানিক ধারণাটি ভারতীয় উপমহাদেশের জ্ঞানচর্চার রথটিকে সম্পূর্ণ বেপথুমতী করে দিল, তার প্রধান দিকটি ভারতের বস্তুবাদী দর্শনের চর্চাকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মদতে পেছনে ঠেলে দেওয়া, বর্ণব্যবস্থা, এবং সর্বোপরি, হাতে-কলমে কাজকে “ছোটলোক”-দের কাজ বলে চিহ্নিত করে এক অবৈজ্ঞানিক বিজ্ঞানচর্চার ধারার জন্ম দেওয়াকেই বিজ্ঞানী রায় দায়ী করেন।এই ঘটনা ঊনবিংশ-বিংশ শতকে বসে তিনি বলেছেন। বিজ্ঞানী রায় দেখিয়েছেন, কেমনভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মণ্য প্রভাব, এবং সেই প্রভাবে বিজ্ঞানচর্চার সুস্থ ধারাটি ক্রমে ক্রমে এক অবৈজ্ঞানিক রূপ নিয়েছে। আবার মৌলবাদী ও পশ্চাদমুখী রাজনীতির কারবারিবৃন্দ সেই অবৈজ্ঞানিক রূপকে অপবিজ্ঞানে পর্যবসিত করেছে।
বর্তমান ভারতে আমরা যা দেখছি, তার বৈশিষ্ট্যগুলি আমরা খুঁজে নিতে পারি। একটি বড়ো বৈশিষ্ট্য হলো যে আজকের হিন্দুত্ব ব্রিগেডের মধ্যে দুটি স্পষ্ট বিভাজন আছে। একদল হিন্দুত্ব মতাদর্শ প্রচারে ইতিহাস, ভূগোল আমদানি না করে কেবল রাজত্ব চালানোর জন্য যেটুকু হিন্দুত্বের ভান করলেই কাজ মিটে যায়, তারা শুধু সেটুকুই করে থাকে। এরা আসলে এই ধর্মযুদ্ধের পদাতিক বাহিনী-- নৌসেনা ( এক বিশেষ দার্শনিক ধারনায় বিশ্বাসী মানুষ, তাঁরা কেউ কেউ প্রতিষ্ঠিত দার্শনিকও হতে পারেন) এবং বিমান বাহিনী ( এঁদের মধ্যে পড়েন অতি-দক্ষিণপন্থী গোঁড়া ও উগ্র জাতীয়তাবাদে জারিত বিজ্ঞানীবৃন্দ) পাশে বা পেছনে থেকে এদের সাহায্য করে। এদের তাই লাগে সাংসদ, বিধায়ক বা পৌরসভার প্রতিনিধিবৃন্দ, যারা চালু সংবিধানকে ব্যবহার করে ক্ষমতা দখল করার কাজে আত্মনিয়োগ করবে। এদের কাজের মূলধন প্রশ্নহীন আনুগত্য। যা কিছু চালু ধারনাকে প্রশ্ন করতে উৎসাহ দেয়, যেমন প্রকৃত বিজ্ঞানশিক্ষা, সেই বিজ্ঞানশিক্ষা এদের কাছে একটি হুমকি বিশেষ। এরা নানা অবিশ্বাস্য “বৈজ্ঞানিক” দাবি করে তাদের “হিন্দু বিজ্ঞান”-এর কথা বলে থাকে। এদের চেতনায় প্রাচীন “হিন্দু সংস্কৃতি” বৌদ্ধ ধর্ম, ইসলাম এবং খ্রিস্টান ধর্মের “কুসংসর্গ” থেকে মুক্ত। নিরীশ্বরবাদী বা একেশ্বরবাদী ধর্মের বিরুদ্ধে আচার আচরণের “হিন্দু ধর্ম”-এ যে বহু-ঈশ্বরবাদের প্রকাশ দেখা যায়, এরা সেই বিষয়টির গোঁড়া সমর্থক।
পাড়ায় পাড়ায় কালি, দুর্গা থেকে শুরু করে শনি-শীতলা পুজোর যে ঢল নেমেছে, তার পেছনে মদতদাতা এই তথাকথিত নির্বাচিত এই জাতের জনপ্রতিনিধিবৃন্দ। অন্য একদল রয়েছেন, যাঁরা বৌদ্ধিক স্তরে প্রাচীন ভারতের, যাকে তাঁরা একমাত্রিক “হিন্দু সংস্কৃতি” বলে বর্ণনা করেন, তার মধ্যেই “হিন্দুত্ব”-র যাবতীয় গৌরবের বস্তুর খোঁজ করেন।
এর হাত ধরেই এসেছে “ভারতীয় জ্ঞানতন্ত্র” চর্চা; নয়া শিক্ষানীতিতে ইতিহাস থেকে শুরু করে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সর্বত্র এই “নয়া জ্ঞান চর্চা” একটি বিষয় হিসেবে পড়ানো হচ্ছে।
এই সব দেখে শুনে আমাদের মানসচক্ষে ভেসে ওঠে “জার্মান বিজ্ঞান”, বা তার আগের “আর্য বিজ্ঞান”, “জার্মান অ্যান্টিকুইটি স্টাডি”, যার মোলায়েম নাম হতে পারে “প্রাচীন জার্মান সভ্যতার অধ্যয়ন”।
এই “অ্যান্টিকুইটি স্টাডি” আদতে কী বস্তু? ১৯০৮ বা ১৯১০ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের যুদ্ধবাজ লবি দ্বারা পরিচালিত শাসনতন্ত্রের পরাজয়ের ঠিক আগে পর্যন্ত, বা বলা যায় ১৯৪৫ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত রাজনৈতিক দিক থেকে যে দক্ষিণপন্থী ধারার প্রভাবে সে দেশের প্রত্নতত্ত্ব থেকে শুরু করে যাকে প্রকৃতি বিজ্ঞান বলে যাকে অভিহিত করা হয়, সেগুলি চর্চার যে কাঠামো জার্মান জাতির অধিকাংশ সদস্যের চেতনা অধিকার করেছিল, তাতে রাসায়নিক সারের ভূমিকা পালন করেছিল এই “জার্মান অ্যান্টিকুইটি বিদ্যাচর্চা”! ইতিহাসের মশলা হিসেবে সেখানে এসেছিল জার্মান জাতির অতীত যুদ্ধজয়ের কাহিনী, তিন তিনটি আগ্রাসী রোমান অভিযানকে ব্যর্থ করার গল্প, জার্মান লেঠেল সর্দার আর্মিনিউস-এর হাতে অতি সুসভ্য রোমান সভ্যতার প্রতিনিধিদের পরাজয়কে জার্মান সংস্কৃতির উৎকৃষ্টতার “প্রমাণ” হিসেবে উপস্থাপনের এক ভ্রান্ত মতাদর্শের কাঠামো নির্মাণ। এর হাত ধরে আসে “খাঁটি জার্মান নাগরিক”-এর গুণাবলির তালিকা, যে তালিকায় একেবারে শীর্ষে অবস্থান করে “ পিতৃভূমির প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য”, “ নিয়ম ও আইনের শাসনের প্রতি যেকোনো মূল্যে বিশ্বস্ত থাকা”।
সারস্বত বিদ্যাচর্চা এবং দক্ষিণপন্থী রাজনীতির মিথোজীবী সম্পর্কের সবচেয়ে শোচনীয় প্রকাশ আমরা দেখি জার্মান ঝটিকা বাহিনীর বল্গাহীন অত্যাচারকে সামাজিক ও বৌদ্ধিক মান্যতা প্রদানের ক্ষেত্রে। হিটলার স্বয়ং এই জার্মান অ্যান্টিকুয়িটি-র গবেষণাপত্রগুলি থেকে উদ্ধৃতি চয়ন করে দেখাতেন যে তাঁদের কাজগুলি আদতে প্রাচীন জার্মান পরম্পরায় বর্ণিত নায়কোচিত কাজগুলির আধুনিক রূপ। মান্য গবেষকদের জার্মান অ্যান্টিকুয়িটি সংক্রান্ত গবেষণা যেমন হিটলারের উত্থানের পেছনে তাত্ত্বিক ও মতাদর্শগত গ্রহণযোগ্যতা নির্মাণ করেছিল, ইতালিতে মুসোলনি-র উত্থানের পেছনে তেমনি ক্রিয়াশীল ছিল প্রাচীন রোম-এর বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-সাহিত্য-দর্শনের “শ্রেষ্ঠত্ব” সংক্রান্ত গবেষণা। মুসোলনি, ঠিক হিটলারের মতোই, প্রাচীন রোম-এর সামরিক দক্ষতা, রাজত্ব বিস্তারের পাশাপাশি “উৎকৃষ্ট” সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে মূলধন করে তাঁদের নিজ নিজ স্বৈরতান্ত্রিক ফাসিস্ট ও নাৎসিতন্ত্র পরিচালনা করেছিলেন, তাতে করে আমাদের প্রতিপাদ্য বিষয়, অর্থাৎ সারস্বত গবেষণার অভিমুখ যদি অপবৈজ্ঞানিক রূপ পরিগ্রহ করে তবে সেই গবেষণাকে আত্মস্থ করে অতি-দক্ষিণপন্থী রাজনীতি সমাজজীবনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, সেই বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, কেননা দুটি ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা একটি সাধারণ সূত্রের সাহায্যে বিষয়গুলির সত্যতা প্রতিষ্ঠিত করতে পারলাম। আমরা যদি আজকের ইস্রায়েল (জায়নবাদ), বা তালিবানের আফগানিস্তান, এমনকি বাইডেনের মার্কিন দেশের উদাহরণ টানি, তাহলেও আমরা আমাদের প্রতিপাদ্য বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে ভুরু ভুরি তথ্য হাজির করতে পারবো।
বার্লিন, মার্চ, ১১, ১৯৩৩। চল্লিশ হাজার দর্শকের উপস্থিতিতে একদল তরুণ, ঝকঝকে আধা সামরিক পোষাকে নয়া জার্মানি জিন্দাবাদ শ্লোগান তুলে বার্লিনের অপেরা স্কোয়ার-এ জমায়েত হয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ আগে নাৎসি পার্টির এসএস সৈন্যদল একটি অগ্নিকুণ্ড তৈরি করে রেখে গিয়েছিল। থেকে থেকে সেই অগ্নিকুণ্ড ফুলকি ছড়াচ্ছে, সেই আগুণের আভায় সেই তরুণদের উদ্ভাসিত মুখ উপস্থিত দর্শকের মনে জার্মান জাতির নতুন ভবিষ্যৎ বিষয়ে নিশ্চিন্ত করছে। এবার এসএস সৈনিকের বিউগুল-এর আওয়াজে আগুয়ান তরুণ দলের সামনের সারির তরুণরা সামনে ঝুঁকে পড়ে স্তূপীকৃত বইয়ের রাশি থেকে একরাশ বই তুলে সেই অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করলো—তাদের কণ্ঠে দৃপ্ত শ্লোগান—
Against class warfare and materialism, for the community of the people and an idealistic way of life!
Against decadence and moral degeneracy, for decency and custom in family and government!
অগ্নিকুণ্ডে এই বই নিক্ষেপের কাজ এরপর অন্যান্য সারির তরুণরা সুশৃঙ্খলভাবে করে চললো, যতক্ষণ না সমস্ত বইয়ের বহ্নুৎসব সম্পূর্ণ হয়! এই অগ্নিকুণ্ডে ভস্মীভূত হয় কার্ল মার্কস, হেলেন কেলার, আরনেস্ট হেমিংওয়ে, অ্যালবার্ট আইনস্টাইন রচিত পুস্তকগুলি। ভবিষ্যতে এই অগ্নি-আহূতিতে বিসর্জিত হবে ইউরোপের বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞদের স্বরলিপির বই, মানবজাতির জ্ঞানচর্চার সবচেয়ে এগিয়ে থাকে চিন্তার ফসলবাহী পুস্তকাদি। এই তরুণদের কুচকাওয়াজের আয়োজকবৃন্দ পূর্বাহ্নেই বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপ্রাচীন গ্রন্থাগারটি লণ্ডভণ্ড করে জন্মসূত্রে ইহুদি বিজ্ঞানীদের সমস্ত বই টেনে রাস্তায় ফেলে রেখেছিল—সেই বইগুলিরও অগ্নি-আহূতি একই সঙ্গে নিষ্পন্ন হয়।
আগুন নিভে যখন কেবল পোড়া কাঠগুলি চুল্লিতে থেকে যায়,তখন সামান্য খুঁড়িয়ে এক খর্বকায় ব্যক্তি আগে থেকেই নির্মিত মঞ্চে এসে দাঁড়ান। তাঁকে ঘিরে উল্লাসধ্বনি স্তিমিত হয়ে এলে তিনি ছোট একটি বক্তৃতা করেন। তার বয়ান এই রকম,
গোয়েবিলস ও হিটলার--নাৎসি জার্মানির সর্বাধিক প্রভাবশালী দুই চরিত্র
The age of an overly refined Jewish intellectualism has come to an end, and the German revolution has made the road clear again for the German character. In the past fourteen years, comrades, as you have been forced in silent shame to suffer the humiliations of the November Republic, the libraries became filled with trash and filth from Jewish asphalt litterateurs.
You do well, in these midnight hours, to consign the unclean spirit of the past to the flames. . . . The old lies in the flames, but the new will arise from the flame of our own hearts. . . . Let it be an oath to many flames! Heil to the Reich and the nation and our leader Adolf Hitler!
এই কথাগুলি এসএস নির্মিত মঞ্চে দাঁড়িয়ে সেদিন বলেছিলেন রাইখ মিনিস্টার জোসেফ গোয়েবিলস, এমন বক্তৃতা তিনি এরপর আরও এক দশক ধরে ক্রমাগত দিয়েই যাবেন, তাঁর মতো রাজনীতিবিদের কাছেই এটাই স্বাভাবিক, হয়তো সেদিনের জার্মানির রাজনৈতিক বাতাবরণে তা খুব বেমানানও নয়।
নাৎসি মতাদর্শ যখন জার্মান সমাজে ধীরে ধীরে তার স্থান করে নিচ্ছে, তখন জার্মানিতে বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে যে বহুস্বরের অস্তিত্ব ছিল, সেই চিত্রের পরিবর্তনের লক্ষণগুলি প্রকাশিত হতে থাকে। নানা সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যগুলিকে এক জায়গায় জড়ো করলে যা দাঁড়ায়, তা খানিকটা এই রকমঃ ১৯৩১ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপকের সংখ্যা ১৭৫ থেকে কমে দাঁড়ায় ১৫৭তে। জাতিবিদ্বেষী রাজনৈতিক চিন্তাধারা জার্মানির বিজ্ঞানচর্চাকে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে দেয়। এই সঙ্গে যুক্ত হয় নাৎসি জার্মানির রাজনৈতিক মতাদর্শের অন্য একটি বিজ্ঞান-বিরোধী দিকও।
আমাদের দেশে হাতে-কলমে কাজকে বর্ণ ব্যবস্থায় যেমন “ছোটলোকদের কাজ” হিসেবে বর্ণহিন্দু সমাজে ধরে নেওয়া হোত, বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতে আমাদের বিজ্ঞানচর্চার জগতে পিছিয়ে পড়ার যা একটি অন্যতম মুখ্য কারণ, সেই অবৈজ্ঞানিক ধারনাটি নাৎসি মতাদর্শেরও একটি মুখ্য স্তম্ভ ছিল। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে নাৎসি দর্শনে বিশ্বাসী নোবেল জয়ী কয়েকজন জার্মান বিজ্ঞানী, যেমন লেনার্ড, স্টার্ক সুপারিশ করেন যে জার্মানিতে অতঃপর বিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্র গুলিতে একই সঙ্গে তত্ত্বীয় এবং নিরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের গবেষণা চলবে না। একটি সংস্থা কেবল নিরীক্ষামূলক গবেষণা এবং অন্য সংস্থা কেবল তত্ত্বীয় গবেষণা করবে, এই দুই গবেষণাগারের মধ্যে কোনও তথ্য আদানপ্রদানের যোগযোগ থাকবে না!
বিজ্ঞানের জগতে গবেষণার ক্ষেত্রে ততদিনে যে মেজাজ বদল ঘটে গেছে, সেখানে তত্ত্ব ও নিরীক্ষা একে অপরের হাত ধরাধরি করে ছাড়া আর এগুতেই পারছে না। বিজ্ঞানের জগতে গোষ্ঠী গবেষণার যে ঘরানা মার্কিন দেশ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিল, জার্মানির কাছে তার সমস্ত উপাদান মজুত থাকা সত্ত্বেও কেবল রাজনৈতিক দিক থেকে নাৎসি মতাদর্শ জার্মানির বিজ্ঞান চর্চায় গুরুতর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
আমাদের দেশ ভারতবর্ষ যেমন “ ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম”-এর নাম করে বিজ্ঞানচর্চার শাঁস যে আন্তর্জাতিকতা, তাকে উপেক্ষা করে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি গ্রহণ করছে, এবং সেখানে অনেক প্রতিষ্ঠিত সরকারি সংস্থার বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি বিজ্ঞানের বদলে হেঁয়ালিতে বিশ্বাসী ব্যক্তিরা দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নীতি নির্ধারণ করছে, নাৎসিদের অধীনে জার্মানিতে প্রায় সেই একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি দেখি। ঐতিহাসিক কালের দিক থেকে যেহেতু নাৎসি জার্মানিতে এই ঘটনা আগে ঘটেছে, তাই বলা যায় যে জাতি-বর্ণ ব্যবস্থায় দীর্ণ ভারত এই ভ্রান্ত পথ পরিহার করার পরিবর্তে আরও দৃঢ়তার সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত নিষ্ফলা পথটিকে গ্রহণ করে দেশের বিজ্ঞানচর্চাকে হয়তো কয়েক শতাব্দী পেছনে ঠেলে দিল!
জার্মানির নোবেলজয়ী দুই বিজ্ঞানী ছিলেন জোহানেস স্টার্ক এবং ফিলিপ লেনার্ড; তাঁরা আবার পরস্পরের খুবই ঘনিষ্ঠ সুহৃদ ছিলেন। তাঁদের এই বন্ধুত্বের অন্যতম যোগসূত্র ছিলো তাঁদের উগ্র জার্মান জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোণ। তাঁরা দুজনেই সেই সময়ের ধ্রুপদী পদার্থ বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ফলিত গবেষণার দিকপাল পণ্ডিত ছিলেন, যদিও তাঁদের কাজ দ্বারা তাঁরা আধুনিক পদার্থ বিজ্ঞানের গবেষণার ধারার ভিত্তি গঠনের কাজে অংশ নিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁরা ক্রমশই বিংশ শতাব্দীর পদার্থবিজ্ঞানের ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন, ফলত তাঁরা আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানচর্চার আঙিনায় ক্রমশ ব্রাত্য হয়ে পড়েন। তখন দুজনে হাত মিলিয়ে রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেন, পাশাপাশি তাঁরা “আর্য ও জার্মান বিজ্ঞান চর্চা” বলতে তাঁরা যে বিজ্ঞানচর্চায় স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন, যা আধুনিক কোয়ান্টাম তত্ত্ব বা আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বের সঙ্গে সংযোগহীন, সেগুলি নিয়ে সরব হন। কিন্তু বিশ শতকের সেই দশকগুলিতে চর্চার বিষয় হিসেবে বেশির বিজ্ঞানী লেনার্ড এবং স্টার্ক দ্বারা চর্চিত বিষয়গুলি আধুনিক ধারার পদার্থবিদদের কাছে গুরুত্ব হারিয়ে বসে।
তাঁরা দুজনে “ ডয়সে ফিসিক” বা “জার্মান পদার্থবিদ্যা” বলে যে আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান তার পেছনে ছিল তিনটি অতি জটিল সামাজিক,রাজনৈতিক বিষয়; এগুলি থেকে আমরা বুঝতে পারি উগ্র জাতীয়তাবাদ, মৌলবাদী দৃষ্টিকোণ কেমনভাবে এমনকি বিজ্ঞানীদের নৈর্বক্তিক যুক্তিগ্রাহ্যতাকে অতিক্রম করে সমাজ ও রাজনীতির আবর্তে বিজ্ঞানীদের নিমজ্জিত করে বিজ্ঞানের অপূরণীয় ক্ষতি করার পাশাপাশি দেশের ও দশের ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে। এই আন্দোলনের পেছনে প্রথম যে প্রবণতাটি আমরা লক্ষ্য করি সেটি এই রকম—যেসব বিজ্ঞানীবৃন্দ আধুনিক কোয়ান্টাম তত্ত্ব ও তার সম্ভবনাতত্ত্ব-ভিত্তিক ফলকে মান্যতা দিতে রাজি ছিলেন না, আবার বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদকে তার নিরীক্ষামূলক পদ্ধতিতে সত্যতা নিরূপণের পরেও মানতে পারছিলেন না, তাঁরা এই দুই তত্ত্বের উদ্গাতা এবং সফল ব্যবহারকারীদের মধ্যে ইহুদি বিজ্ঞানীদের ঊজ্জ্বল উপস্থিতি দেখে এই ইহুদি-বিরোধী জেহাদে যোগ দেন এই আশায় যে, তাঁদের চর্চার বিষয়গুলি বুঝি জার্মানিতে আবার পাদপ্রদীপের আলোতে আসবে এবং বিজ্ঞানী হিসেবে তাঁরা আবার তাঁদের হারানো গরিমা ফিরে পাবেন। দ্বিতীয় যাঁরা এই উদ্যোগে সামিল হন, তাঁরা আইনস্টাইন-এর আন্তর্জাতিক খ্যাতি মেনে নিতে পারেন নি, লেনার্ড এবং স্টার্ক খাঁটি জার্মান নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও সেই খ্যাতি তাঁরা পান নি। তাঁরা এই ঘটনার মধ্যে আন্তর্জাতিক ইহুদি ঐক্য ও যুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের ফলে জার্মান জাতিকে অবজ্ঞা করার চক্রান্ত বলে মনে করে এই আন্দোলনে যোগ দেন। তৃতীয় ধারায় ছিলেন, অপেক্ষাকৃত কম উগ্র জাতীয়তাবাদী ধারার জার্মান বিজ্ঞানীরা, যাঁরা কিছুতেই ভুলতে পারেন নি যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আইনস্টাইন জার্মান যুদ্ধ প্রচেষ্টার বিরোধিতা করেছিলেন, এবং জার্মান নাগরিকত্ব ত্যাগ করে অন্য দেশে চলে যান। এই কারণে তাঁরা আইনস্টাইন ও অন্যান্য যাঁরা আইনস্টাইনকে সমর্থন করতেন, যেমন খাঁটি জার্মান ফন লাউয়ে, বিজ্ঞানী ভিয়েন, যাঁরা মোটেই ইহুদি ছিলেন না, কোনও জাতি বিদ্বেষী অবস্থান ছাড়াই তাঁরা এই বিরোধিতার কারণে এই আন্দোলনে সামিল হন। এর ফলে যে জার্মানিতে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের আবাহন ঘটে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক, সমারফেল্ড, শ্রোয়েডিঞ্জার ও হাইসেনবার্গ-এর হাতে, সেই জার্মানির বিজ্ঞানীরা এই আধুনিক বিজ্ঞানকে জাতিবিদ্বেষী দৃষ্টিতে দেখে বিজ্ঞান ও সমাজের অপ্রত্যাহারযোগ্য ক্ষতি করেছেন।
১৯২৩ সালের বসন্তে জার্মান জনগণ সর্বপ্রথম নাৎসি উগ্র জাতীয়তাবাদ ও জাতিবিদ্বেষের সংমিশ্রণে যে ভয়ানক উগ্র দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থান ঘটছে, তার কটূ স্বাদ পান। হিটলার ও তার নাৎসী পার্টির “কমরেডবৃন্দ” ইতালির মুসোলিনির রোম অভিযানের আদলে জার্মানির মিউনিখ শহরে একটি সশস্ত্র অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা চালায় এবং ব্যর্থ হয়। এই প্রচেষ্টার মাধ্যমে তারা প্রথম সফলভাবে সমাজে নিজেদের অস্তিত্ব প্রকাশ করে। এই ঘটনার এক বছর পর, হিটলার যখন ল্যান্ডসবার্গ কারাগারে এই অভ্যুত্থানের ফলে হিংসা ও মৃত্যুর দায়ে সাজা ভোগ করছেন, তখন স্টার্ক ও তাঁর স্ত্রী কারাগারে হিটলারকে চিঠি দিয়ে জানান যে সাজা শেষে স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য হিটলার যেন তাঁদের আতিথ্য গ্রহণ করেন। হিটলারের সাজার পরিমাণ কমানোর পক্ষে এবং তাঁর রাজনীতিকে সমর্থন করে লেনার্ড ও স্টার্ক একটি খোলা চিঠি প্রকাশ করেন ১৯২৪ সালে। সেই চিঠিতে তাঁরা কাব্যিক জার্মান ভাষায় যা লেখেন তার প্রামান্য ইংরেজি অনুবাদ নাৎসি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়—“The struggle of the spirits of darkness against the bearers of light...[Hitler] and his comrades in struggle ... appear to us as gifts of God from a long darkened earlier time when races were still purer, persons still greater, spirits still less fraudulent”।
হিটলার জার্মানির ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার আগেই ১৯৩০ সালে স্টার্ক নাৎসি পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৩৩ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে হিটলার-এর নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দখলের আগে জার্মানিতে আরও দুটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৩২ সালের নির্বাচনে স্টার্ক নাৎসি পার্টির সমর্থনে নিজেকে নোবেলজয়ী জার্মান বিজ্ঞানী হিসেবে ঘোষণা করে প্রচারপত্র লিখে নাৎসি পার্টির পক্ষে প্রভূত পরিমাণে ভোট সংগ্রহে সক্রিয় ছিলেন। অন্য নির্বাচনে তিনি তাঁর খামারবাড়িতে নাৎসি পার্টির সমর্থনে একের পর এক বিরাট বিরাট জনসভা সংগঠিত করেন, তিনি যে জার্মান বিজ্ঞানী হিসেবে “ইহুদি চক্রান্ত” ব্যর্থ করে নোবেল পেয়েছেন, ভোটের প্রচারে সেটি বারংবার ব্যবহৃত হয়েছিল।
এই কাজের “প্রতিদান”-এ নাৎসি সরকার স্টার্ক এবং লেনার্ড-এর মাধ্যমে সারা জার্মানির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণাকে “আর্য বিজ্ঞান”-এর ধাঁচে সাজানোর কথা ভাবে। ক্ষমতা দখলের পর পরই, ১৯৩৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জার্মান ফিজিক্যাল সোসাইটি-র একটি অধিবেশন বসে উরজবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই অধিবেশনে স্টার্ক বলেন যে হিটলার যেমন নিজেকে দেশের কর্ণধার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, স্টার্ক তেমনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নিজেকে কর্ণধার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবেন। তিনি তাঁর আওতায় সারা দেশের বিজ্ঞান গবেষণাকে কেন্দ্রীভূত করে পদার্থবিজ্ঞানের সমস্ত গবেষণা পত্রিকা, সমস্ত বৈজ্ঞানিক বইয়ের প্রকাশনার একমাত্র সম্পাদক হবেন, তাঁর কথাই হবে বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে শেষ কথা। কী কী বিষয়ে গবেষণা করা যাবে বা যাবে না, কে কোন গবেষণার জন্য সরকার থেকে কতটা অনুদান পাবেন বা পাবেন না, তার পুরোটাই এখন স্টার্ক এবং লেনার্ড নিয়ন্ত্রণ করবেন। পাঠকেদের মনে পড়বে আমাদের মাননীয় প্রাধানমন্ত্রী প্রায় এই ধরনের একটি পদক্ষেপ এখনই করে ফেলেছেন ! স্টার্ক বলেন যে বিজ্ঞানীদের অবশ্যই “গবেষণার স্বাধীনতা” থাকবে, তবে তা সীমাবদ্ধ থাকবে স্টার্ক নির্দেশিত গবেষণা প্রকল্পের মধ্য থেকে গবেষকের পছন্দ মতো প্রকল্পটি বেছে নেওয়ার !
নাৎসি সরকার স্টার্ক-কে ফিজিক্যাল-টেকনিক্যাল সংস্থার নির্দেশক পদ দেয়। তিনি এই পদে যোগ দিয়েই যে নীতি অনুসারে নাৎসি পার্টি পরিচালিত হয়, সেই একই নীতি অনুসারে তিনি এই বৈজ্ঞানিক সংস্থাটি চালানোর কথা ঘোষণা করেন। প্রত্যেক বিজ্ঞানী তাঁর ঊর্ধতন বিজ্ঞানীর প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্য জ্ঞাপন করবেন, তাঁকে যা করতে বলা হবে, তাঁকে ঠিক সেই কাজ করতে হবে, এমনকি বৈজ্ঞানিক প্রশ্ন পর্যন্ত করা যাবে না; প্রশ্ন করা আদতে ইহুদি চক্রান্ত, ফলে দেশদ্রোহিতার সমতুল্য কাজ হিসেবে পরিগণিত হবে। এই সব অপবৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ করা জার্মানির মৌলিক গবেষণাকে প্রায় স্তব্ধ করে দেয় এবং নানান অপবৈজ্ঞানিক প্রকল্পে বহু অর্থ ও মানবসম্পদের অপব্যবহার করা হয়। এর ফলে মানবজাতির জ্ঞানভাণ্ডারে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগের সময়কালে দেশ হিসেবে জার্মানির পক্ষ থেকে পঠনপাঠন ও গবেষণায় যে অবদান ছিল, তার পরিমাণও দ্রুতগতিতে কমে আসতে থাকে।
জার্মানির বিজ্ঞান গবেষণার প্রাতিষ্ঠানিকতা ও সমরায়ন ঘটে স্টার্ক-এর হাত ধরে। তিনি নৌবাহিনী, বিমানবাহিনীর জন্য অস্ত্র নির্মাণ ও অন্যান্য সহায়তার জন্য গবেষণাগার নির্মাণ করেন। তাঁর ধারনা ছিল এই সব অস্ত্রের মাধ্যমে তিনি হিটলারের বিশ্বজয় পরিকল্পনার একজন অংশীদার হয়ে উঠবেন।
১৯৩৫ সালে লেনার্ড চার খণ্ডে একটি বই লেখেন, যার নাম “ডয়সে ফিসিক” বা “জার্মান পদার্থবিদ্যা”। এই বইয়ের প্রতিপাদ্য ছিল মোট তিনটি; ১) মানব তি যা কিছু নির্মাণ করেছে, তার পেছনে রয়েছে “শুদ্ধ রক্ত ও শুদ্ধ জাতি”, ২) ইহুদিরা তাদের নিজেদের পদার্থবিদ্যা নির্মাণ করেছে, এবং ৩) এই ইহুদি পদার্থবিজ্ঞান অবশ্যই “আর্য বিজ্ঞান” বা “নর্ডিক বিজ্ঞান”-এর চেয়ে “নিকৃষ্ট”।
যুদ্ধের শেষে লেনার্ড ১৯৪৭ সালে তাঁর নিজের বাড়িতে মারা যান। মিত্রশক্তি যখন জার্মানির একাংশ দখল করে, তারা লেনার্ডকে আটক করে বলে জনশ্রুতি। কী পরিস্থিতিতে লেনার্ড-এর মৃত্যু হয় তা আজও রহস্যাবৃত।
অন্যদিকে স্টার্ক মিত্রশক্তির সৈনিকদের হাতে নাৎসি সমর্থক হিসেবে গ্রেপ্তার হন। তাঁকে হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোফেসারের পদ থেকে বিতাড়িত করা হয়। তিনি দুদফায় নাৎসি-নির্মূলীকরণ প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হন। প্রথম দফায় তিনি নাৎসি সহযোগী হিসেবে চার বছরের কারাবাসের দণ্ডপ্রাপ্ত হন। তাঁর বয়সের কথা চিন্তা করে এবং তাঁর আবেদন বিচার করে তাঁকে আর্থিক দণ্ড বরাদ্দ করা হয়। ১৯৫৭ সালে ৮৩ বছর বয়সে স্টার্ক-এর মৃত্যু হয়, তিনি আমৃত্যু তাঁর নাৎসি মনোভাব বজায় রেখেছিলেন।
যে কোন “দেশীয় জ্ঞানতন্ত্র”, তা সে জার্মান জাতিদম্ভ ভিত্তিক বা “বেদ ভিত্তিক”, যাই হোক না কেন, সেই প্রকল্পগুলি শেষ বিচারে ব্যর্থ হতে বাধ্য। এই প্রকল্পগুলি মৌলবাদী এবং অথবা স্বৈরতন্ত্রী-ফ্যাসিবাদী শাসকদের পূর্ণ রাজনৈতিক মদত শেষ পর্যন্ত পায় না। বিজ্ঞান বিষয়ে নির্বোধ এই তথাকথিত শাসকদের কাছে এই সব অপবৈজ্ঞানিক প্রকল্পগুলি তাদের রাজত্ব টিকিয়ে রাখার লক্ষ্য সাধনের অনেক উপায়ের একটি উপায়মাত্র; যখনই সেই লক্ষ্য সাধিত হয়ে যায়, এই সব প্রকল্পে কর্মরত “বিজ্ঞানীরা” শাসকের কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। জার্মানিতে যতদিন ইহুদি বিদ্বেষ উসকে দিয়ে সমাজের সব বিভাগ থেকে ইহুদি বিতাড়ন প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে যায়, তখন জার্মানিতে “ডয়সে ফিসিক” আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তাও ফুরিয়ে যায়।
ফ্যাসিবাদকে হয় পুরোপুরি গ্রহণ করতে হয়, নয় তার সর্বাংশে বিরোধিতা করতে হয়। মাঝামাঝি স্থানে থাকলে, নষ্ট রাজনীতি আর তার সঙ্গে যুক্ত তস্কর, ন্যায়নীতিহীন, চোর, গুন্ডা ও বদমায়েসদের সঙ্গে সহাবস্থান বজায় রাখতে হবে। এদের কোনও নিজস্ব রাজনীতি নেই, এরা সুবিধাবাদী, এদের কোনও নিজস্ব দক্ষতাও নেই, এরা চাটুকারবৃত্তির মাধ্যমে নিজেদের সুবিধা কিনে নেয়। যেসব মানুষের দক্ষতা আছে এবং যারা ক্ষমতার কাছে না থেকেও সুস্থ ও নিশ্চিন্ত জীবনযাপনে সক্ষম, সেই সব মানুষ, তাদের মতাদর্শ যা-ই হোক না কেন, এরা শাসক নামে তস্করবৃন্দ এই মানুষদের শত্রু মনে করে এবং তাদের হটিয়ে দেয়। স্টার্ক এবং লেনার্ড তাঁদের শহরের সবচেয়ে গুন্ডা ও সবচেয়ে দুর্নীতিবাজ নাৎসি নেতার কুনজরে পড়ে হেনস্থার শিকার হয়েছিলেন। আমাদের মনে পড়বে পাড়ার উঠতি মস্তান নেতাজির বাড়িতে গিয়ে তোলাবাজির জন্য “সুভাষ দা”-র খোঁজ করেছিল! এই সব খুচরো নাৎসি নেতারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে, পশ্চিম বার্লিন দখল করা মার্কিন সৈন্যদের উৎকোচ দিয়ে তারা যে কোনদিন নাৎসি ছিল না, তেমন শংসাপত্র বাগিয়ে নেয় এবং স্টার্ক-এর বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়ে তাঁর কারাবাসের পাকা বন্দোবস্ত করে দেয়। অন্যরা ন্যুরেমবুর্গ বিচারে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে ফাঁসি যান।
স্টার্ক বা লেনার্ড বা অন্যান্যরা গণহত্যার ভাগীদার হিসেবে, বিজ্ঞানের জগতের কলঙ্ক হিসেবে চিহ্নিত হয়েই রইলেন। স্টার্ক এফেক্ট নামক এক আলোকসামান্য বৈজ্ঞানিক ক্রিয়ার আবিষ্কর্তা স্টার্ক-এর চেয়ে নাৎসি স্টার্ক অনেক কুখ্যাত হয়ে আছেন, লেনার্ড লেখচিত্রের মতো অনন্যসাধারণ এক নিরীক্ষামূলক কাজের উদ্গাতা, বিজ্ঞানী লেনার্ডকে কলঙ্কের কালিমায় ম্লান করে দিয়েছেন নাৎসি লেনার্ড। বিপরীতে আইনস্টাইন বা অন্যান্য যে সব “ইহুদি” বিজ্ঞানী ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা করে জার্মানি ছেড়ে চলে গেছেন, বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিজ্ঞানী ও পূর্ণ মানুষ হিসেবে তাঁদের অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে বিরাজ করছে। তাপ্পি মারা জাহাজে চড়ে ছোটোখাটো নদী পার হওয়া হয়তো যায়, কিন্তু সেই জাহাজে অতলান্ত সাগর পাড়ি দেওয়ার মূঢ়তা কেবল তাদেরই সাজে, যারা অপবৈজ্ঞানিকতায় প্রশ্নহীন আস্থা জ্ঞাপন করে থাকে।